রবিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্বজনদের এখনো খুঁজছে ওরা

ভীতি কাটছে না চকবাজারে, ফের আগুন আতঙ্ক আহত ১০

সাখাওয়াত কাওসার

স্বজনদের এখনো খুঁজছে ওরা

চকবাজারে আগুনে নিখোঁজদের জন্য গতকাল স্বজনদের আহাজারি। অনেকের হাতেই ছিল প্রিয়জনের ছবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আহসান উল্লাহ ১৫ বছর ধরে ব্যবসা করেন ঢাকার চকবাজারে। থাকেন সাতরওজা এলাকায়। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে চুড়িহাট্টার হায়দার ফার্মেসিতে ওষুধ নিতে এসেছিলেন তিনি। এর কিছু সময় পরই ৫ রাস্তার মোড়ের ওয়াহেদ ম্যানশনের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড  ঘটে। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। আহসানের ছবি এবং একটি ভিডিও ফুটেজ নিয়ে ঘুরছেন তার স্বজনরা। একবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গ তো আরেকবার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গ। আবার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গ কিংবা ঘটনাস্থল চুড়িহাট্টার পোড়া ভবনে যাচ্ছেন তারা। কোথাও সন্ধান মেলেনি আহসান উল্লাহর।

এনামুল হকের  বাসা কেরানীগঞ্জ আটিবাজার এলাকায় হলেও ব্যবসা করেন চকবাজারের সাকুরা মার্কেটে। ছেলে ওয়াসিফ আরাফাতের নামে দোকানের নাম দিয়েছেন ওয়াসিফ এন্টারপ্রাইজ। রাত ১০টার দিকে বাসায় যেতে দোকান কর্মচারী তুষারকে নিয়ে রিকশায় করে রওনা দিয়েছিলেন তিনি। চুড়িহাট্টার আগুনে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলেও এখন খোঁজ নেই এনামের। ছবি নিয়ে তার স্বজনরা ঢামেক, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে খুঁজছেন। কোথাও সন্ধান নেই মাহমুদা বেগমের নাড়িছেঁড়া ধন এনামের। শুধু এ দুজনই নয়, এমন আরও অনেকেই তাদের স্বজনের খোঁজে ঘুরছেন চকবাজার থেকে মর্গ। কেউ কেউ কাকভোর থেকেই বসে থাকে পোড়া ভবনের সামনে। তাদের বিশ্বাস, তাদের স্বজনরা এই বুঝি ফিরবে। গতকাল স্বজনদের খুঁজতে এসে ভবনের পোড়ামাটি ধরে অনেকেই হাউমাউ করে কেঁদেছে। তাদের আহাজারিতে সেখানকার বাতাস ভারি হয়ে আসে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও যেন সবাই হারিয়ে ফেলেছিল।

এদিকে গতকাল চুড়িহাট্টার সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টের রাসায়নিক দ্রব্যগুলো সরাতে শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কর্তৃপক্ষ। কেমিক্যাল অপসারণে চালু করা হয়েছে হটলাইন। ঢাকা জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্রে দায়িত্বরত সিনিয়র সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল মনসুর বলেন, আজ (শনিবার) পর্যন্ত আমরা ৪৭টি লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছি। এখন তাদের তাদের কাছে আরও ২০টি লাশ রয়েছে। এসব লাশের বিপরীতে ১৮টি পক্ষের স্বজনরা ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন সিআইডির ফরেনসিক টিমের কাছে। গতকাল পর্যন্ত দুটি লাশের পক্ষের বিপরীতে কোনো দাবিদার পাওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষের সব ধরনের ক্লিয়ারেন্স পেলে আমরা সরকারের দেওয়া সব রকম সুবিধাসহ লাশ হস্তান্তর করতে প্রস্তুত।

গতকাল বেলা সোয়া ১টার দিকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজে ব্যর্থ হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে যান নিখোঁজ আহসান উল্লøাহ্র স্বজনরা। মর্গে সব লাশ দেখে একটি লাশের দিকে নজর আটকায় আহসানের ভাই আনোয়ার হোসেন ও কর্মচারী মো. রাশেদের। লাশের চেহারা বিকৃত হয়ে গেলেও দেহের অবয়ব আর লাশের গায়ে থাকা শার্ট দেখার পরপরই মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গের সামনে অবতারণা হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। মর্গ কর্তৃপক্ষকে তারা দেখান তাদের কাছে থাকা একটি সিসিটিভি ফুটেজ। বলতে থাকেন নিখোঁজ হওয়ার দিন বাদশা মার্কেটের মান্নান মিয়ার দোকানে তার কারখানায় উৎপাদিত লেডিস ব্যাগ সরবরাহের দৃশ্যের ফুটেজ এটা। এ সময়ও আহসানের গায়ে ছিল এই শার্ট। তাদের এমন আবেদনে হার মানেন মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গের কর্তৃপক্ষ। লাশ বুঝে না পেলেও শার্টের এক টুকরো কাপড়েই নিখোঁজ ভাইকে যেন খুঁজে পেলেন সহোদর আনোয়ার। একের পর এক চুমু খাচ্ছিলেন আনোয়ার, রাশেদ। একপর্যায়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন আনোয়ার।

কর্মচারী রাশেদ জানান, রাত ৯টার দিকে সাতরওজাস্থ তার কারখানায় (পাপ্পুর বাড়ি) ফেরেন আহসান। ওই সময় ভাই আনোয়ার এবং কারখানার অন্য সবাইকে নিয়ে পেটিস খান। সাড়ে ৯টার দিকে চুড়িহাট্টার হায়দার ফার্মেসিতে যান শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগের ওষুধ আনতে। তবে আর ফেরেননি তার মালিক আহসান। ওই শার্ট থেকে এক টুকরো কাপড় নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত জেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্রে। সেখানে সিআইডির কাছে ডিএনএ নমুনা দেন আনোয়ার।

এর বাইরে জামা ও ট্রাউজারের এক টুকরো কাপড় দেখে গতকাল  বেলা ১১টার দিকে হায়দার মেডিকেল হলের আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মৃতদেহ শনাক্ত করেছে তার পরিবার। তার বড়ভাই সাজ্জাদুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার দিন সারা দিনই তার ভাই তার সঙ্গেই ছিলেন। পুরো দেহ পুড়ে গেলেও কনুইয়ের কাছে জামার একটি টুকরো ও পরনে ট্রাউজারের একটি টুকরো ছিল। তা দেখে তিনি ভাইকে শনাক্ত করতে পেরেছেন।

আনোয়ার হোসেনের লাশ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে ছিল। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সেলিম রেজা জানান, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটসহ মৃতদেহের দাবিদারকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মৃতদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশটি হস্তান্তর করা হয়েছে।

গতকাল সকালে পাঁচ মাস বয়সী একটি শিশুর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছেন সিআইডির ডিএনএ ল্যাব কর্মকর্তারা। শিশুটির নাম আবুল হোসেন। মা শিরিন বেগমের সঙ্গে এসেছিল শিশুটি। আবুল হোসেনের বাবা নুরুজ্জামান হাওলাদার নিখোঁজ।

সিআইডির সহকারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট আশরাফুল আলম বলেন, নিয়মিত মৃতদেহের নমুনা দিয়ে শনাক্ত করা হলেও অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে তা সময়সাপেক্ষ। যারা ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছেন, তাদের রক্ত ও মুখের ভিতর থেকে কোষ সংগ্রহ করা হচ্ছে। মৃতদেহ থেকে হাড় ও দাঁতের নমুনা নেওয়া হয়েছে। মৃতদেহ শনাক্ত করতে এক থেকে ছয় মাস সময় লাগতে পারে।

কেমিক্যাল অপসারণে হটলাইন : চুড়িহাট্টা মোড়ে মেয়র সাঈদ খোকনের বক্তব্যের পরপরই ওয়াহেদ ম্যানশনে অভিযান শুরু করে সিটি করপোরেশনের দল। মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, পুরান ঢাকার যেসব বাড়িতে কেমিক্যালের গুদাম রয়েছে ক্রমান্বয়ে সেগুলোতে অভিযান চালানো হবে। সেসব বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেমিক্যাল পেলেই ৯৫৫৬০১৪ এই নম্বরে কল করতে অনুরোধ করেন তিনি।

নোয়াখালীতে শোকের মাতম :  আমাদের নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, চকবাজারে অগ্নিকাে  নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীসহ বিভিন্ন উপজেলার নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। স্বজন হারানোর বেদনায় শোকে মুহ্যমান পরিবারের সদস্যরা। চকবাজার ট্র্যাজেডিতে নিহতদের মধ্যে নোয়াখালীর ১৩ জনের পরিচয় মিলেছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস। এদের মধ্যে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার নাটেশ্বর ইউনিয়নের ঘোষকামতা গ্রামের সাহেব উল্লাহর ছেলে মাসুদ রানা ও মাহবুবুর রহমান রাজু। একমাত্র উপার্জনক্ষম দুই সন্তানকে হারিয়ে দিশাহারা পরিবার। শুক্রবার সকালে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়।

তদন্ত রিপোর্ট ৩ এপ্রিল দাখিলের নির্দেশ : পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাে র ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তিন এপ্রিল দিন ধার্য করেছে আদালত। গত শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম কনক বড়ুয়া এ আদেশ দেন। এ বিষয়ে আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) মো. মাজাহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, চকবাজার অগ্নিকাে র ঘটনায় জুম্মুন নামের এক ব্যক্তি মারা যায়। তার ছেলে মো. আসিফ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় বৃহস্পতিবার একটি মামলা করে। মামলায় চকবাজারের নন্দকুমার দত্ত রোডের চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশে ৬৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের ‘ওয়াহিদ ম্যানসন’ ভবনের মালিক মৃত হাজী আবদুল ওয়াহেদের দুই ছেলেকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা হলেন- হাসান (৫০) ও সোহেল শহীদ (৪৫)। এ ছাড়া অজ্ঞাত আরও ১০/১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলার শুনানি শেষে বিচারক তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য ৩ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন।

এদিকে এই অগ্নিকাে র ঘটনায় চকবাজার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা করেছে। এ মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।

চকবাজারে ফের আগুন আতঙ্ক আহত ১০ : পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় নতুন করে বিদ্যুতের তারে আগুনের ফুলকি (স্পার্ক) দেখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় মসজিদ থেকে বের হতে গিয়ে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ মুসল্লি। ওই এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের তিন দিন পর গতকাল এ ঘটনা ঘটল।

জানা গেছে, সন্ধ্যায় ওই এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ চালুর চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। এ সময় বিভিন্ন জায়গায় আগুনের ফুলকি দেখে এলাকার মসজিদে থাকা মুসল্লিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে আহত হন ১০ মুসল্লি।

প্রসঙ্গত, গত বুধবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে চকবাজারে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। পরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে আরও কয়েকটি ভবনে। এ ঘটনায় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আগুন লাগার পর পরই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় ওই এলাকায়। দিনের আলোতে চেষ্টা না করে অন্ধকারে কেন বিদ্যুৎ সংযোগ  দেওয়ার  চেষ্টা- তা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর