শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বস দেখে নায়ক নয় খলনায়ক

মির্জা মেহেদী তমাল

বস দেখে নায়ক নয় খলনায়ক

পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান। বাসা খিলক্ষেত। ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে এক বন্ধুকে নিয়ে বাসের জন্য সেদিন বিকালে অপেক্ষা করছিলেন। সুপ্রভাত বাসে সিট থাকায় তারা দুজন তাতে চড়ে বসেন। বাসটি নর্দা যাওয়ার পর হঠাৎ দুটি মোটরসাইকেল বাসের সামনে এসে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়ায়। চালক বাসটি থামিয়ে দেয়। মোটরসাইকেলে আসা চারজনের মধ্যে তিনজন দ্রুত বাসটিতে উঠে যায়। তারা বাসটি সাইড করতে বলে। তাদের একজনের কাছে ওয়্যারলেস সেট ও দুজনের পরনে ডিবি লেখা জ্যাকেট ছিল। বাসের যাত্রীদের মধ্যে থেকে কাউকে খুঁজছিল। এ সময় যাত্রীদের মঝে আতঙ্ক। কেউ একজন দাঁড়িয়ে বললেন, কী ব্যাপার ভাই। বাস থামিয়ে রেখেছেন কেন। এ কথা বলতেই তিনজনের একজন বলে উঠে, আমরা পুলিশের লোক। এই বাসে একজন মাদক ব্যবসায়ী আছে বলে খবর রয়েছে। আপনারা আমাদের সাহায্য করবেন বলে আশা করছি। এ সময় যাত্রীরা বলেন, যদি এমন কেউ থাকে, আমরা অবশ্যই সাহায্য করব। পুলিশের তিনজন যাত্রীদের সিটের কাছে গিয়ে খোঁজ করতে থাকে কাক্সিক্ষত ব্যক্তিকে। এ সময় তারা মোস্তাফিজুর রহমানের সিটের কাছে এসে থেমে যায়। তারা মোস্তাফিজুর রহমান ও তার বন্ধুর উদ্দেশে বলে, আমাদের কাছে তথ্য আছে তোরা ইয়াবা খাস, তোদের কাছে ইয়াবা আছে। তোরা মাদক ব্যবসায়ী। চল আমাদের সঙ্গে।  এই কথা বলে তারা মোস্তাফিজুর রহমান এবং তার বন্ধুকে জোরপূর্বক বাস থেকে নামিয়ে আনে। যাত্রীরা এ সময় পুলিশকে বাধা দেয়নি।

‘এরপর তাদের দুজনকে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মারে এবং মোস্তাফিজুর রহমানের পকেটে থাকা নগদ ৪২ হাজার টাকা ও ২টি মোবাইল ফোন সেট এবং তার বন্ধুর কাছে থাকা নগদ ১৫ হাজার টাকা ও ১টি মোবাইল ফোন সেট জোর করে ছিনিয়ে নেয়। মোস্তাফিজের বন্ধুর পকেটে তল্লাশি করে। কিন্তু ইয়াবা বা অন্য কোনো মাদক খুঁজে পায় না। তাকে ছেড়ে দেয়। পরে মোস্তাফিজের হাতে থাকা ব্যাগে ইয়াবা আছে বলে তারা চ্যালেঞ্জ করে। মোস্তাফিজ অস্বীকার করে। কিন্তু পুলিশ দল মোস্তাফিজকে বলে, চল থানায়। সেখানেই তল্লাশি হবে। মোস্তাফিজ তাতে রাজি হয়। মোস্তাফিজ তাদের মোটরসাইকেলে চড়ে বসেন। মোস্তাফিজকে থানায় নিয়ে মামলা দেওয়ার কথা বলে গুলশান, বাড্ডা, হাতিরঝিল এলাকায় ঘুরতে থাকে। এমন ঘুরতে ঘুরতে রাত বাড়ে। তারা যখন ঢাকা শহর ঘুরতে ঘুরতে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় আসে, তখন রাত সাড়ে ৩টা। বিএসটিআই মোড়ে এনে তারা মোস্তাফিজকে বলে, ‘তোকে আজকের মতো ছেড়ে দিলাম। তুই আর ইয়াবা খাবি না।’ এ সময় টানাটানি করে তার ব্যাগটি নেওয়ার চেষ্টা করে। ব্যাগে মোস্তাফিজের ব্যবসার ১৩ লাখ টাকা ছিল। একপর্যায়ে মোস্তাফিজ বুঝতে পারেন তারা পুলিশ নয়। তখন তিনি ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। এ সময় পুলিশের দল ব্যাগটি ছেড়ে দিয়ে মোটরসাইকেল যোগে দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা (নম্বর ৩১) দায়ের করেন। মামলাটি পিবিআই তদন্ত শুরু করে। তারা বের করে আনে আসল তথ্য। পিবিআই জানতে পারে, তারা পুলিশ নয়। পুলিশ পরিচয়ধারী অপরাধী। পিবিআই জানায়, ‘পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী-প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকরা এই চক্রের সোর্স। তারা তথ্য দিতেন-কোন ব্যবসায়ী কত টাকা নিয়ে ফেরত যাচ্ছেন। তথ্যানুযায়ী ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে থেকে অনুসরণ করা হতো। এরপর অন্য এলাকায় যাওয়ার পর কখনো মোটরসাইকেল বা কখনো মাইক্রোবাসে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে সবকিছু কেড়ে নিত তারা। তারা ডাকাতি থেকে প্রাপ্ত অর্থের ৪০ ভাগ সোর্সদের দিত।’ এ ঘটনায় রাজধানী বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় ডিবির ইন্সপেক্টর পরিচয়দানকারী জাবেদ আহমেদ ওরফে বাবু ও সোহাগ খন্দকার, উপ-পরিদর্শক পরিচয়দানকারী নাজমুল হোসেন ও দেলোয়ার হোসেন, কনস্টেবল পরিচয়দানকারী আসাদুজ্জামান, বুলবুল আহমেদ, হারুন ওরফে হিরা। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ৪টি মোটরসাইকেল, ৩টি ওয়্যারলেস, এক জোড়া হ্যান্ডকাফ, খেলনা পিস্তল ২টি, চাপাতি ১টি, ১টি চাকু উদ্ধার করা হয়। পরে গ্রেফতার হয় দলের প্রধান এ কে এম রানা। নিজেকে ডিবির এএসপি (এসি) পরিচয় দেন তিনি। দীর্ঘ অনুসন্ধান ও অভিযানের পর তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। জিজ্ঞাসাবাদে রানা পিবিআইকে জানিয়েছেন, বলিউডের হিন্দি সিনেমা ‘বস’ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সংঘবদ্ধ এ চক্রটি গড়ে তোলেন তিনি। নিজেই দলের বস সেজে পুলিশ পরিচয়ে বিভিন্ন এলাকায় এভাবে ডাকাতি করে থাকে। পুলিশ জানায়, এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি দেখলে অবশ্যই পুলিশকে খবর দিতে হবে। তাছাড়া ৯৯৯-এ কল করলেও তাৎক্ষণিক পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর