শিরোনাম
রবিবার, ৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

চিকিৎসক আছে সাইনবোর্ডে

মির্জা মেহেদী তমাল

চিকিৎসক আছে সাইনবোর্ডে

পাশাপাশি এক ডজনের বেশি ডেন্টাল চেম্বার। কোনো চেম্বারে একজন, কোথাও আবার দুজন বিডিএস ডাক্তারের সাইনবোর্ড। কখনো কখনো ডাক্তারও বদলে যায়। রোগী দেখার সময় লেখা রয়েছে বিকাল থেকে সন্ধ্যা। কিন্তু দিনভর আসছে রোগী। চিকিৎসাও চলছে। অপারেশন থেকে শুরু করে দাতের সব ধরনের চিকিৎসা চলছে সেখানে। এ দৃশ্য মিরপুর ঢাকা ডেন্টাল কলেজের সামনের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ডেন্টাল চেম্বারগুলোতে দিনভর যারা চিকিৎসা করছেন, তাদের কেউই ডাক্তার নয়। এরা ঢাকা ডেন্টাল কলেজের টেকনিশিয়ান। তারাই চেম্বারগুলোর মালিক। ডাক্তার সেজে তারাই বছরের পর বছর চিকিৎসা করছেন। তাদের পকেটে থাকে চেম্বারের ভিজিটিং কার্ড। ডেন্টাল কলেজ থেকে রোগী ভাগিয়ে পাঠিয়ে দেন চেম্বারে। কারণ ডেন্টাল কলেজে সাত দিনের রুট ক্যানেল চিকিৎসা করাতে সময় লাগে ৬ থেকে ৯ মাস। পর্যাপ্ত ডেন্টিস্ট ও ফাঁকা চেয়ার থাকার পরও রোগীদের ২-৩ মাস পর সিরিয়াল দেওয়া হয়। কারণ যে ডেন্টিস্টরা সিরিয়াল দেন তারাই আবার বাইরে এসে ওইসব চেম্বারে চিকিৎসা করেন। আবার রোগী পাঠালে তার জন্য কমিশনও পান। এসব নামসর্বস্ব ডেন্টাল ক্লিনিক থেকে চিকিৎসা নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ রোগীরা। এর ফলে একদিকে যেমন চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে নগদ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তেমনি ভুল চিকিৎসায় রোগীদের ঠেলে দিচ্ছে বিপদের মুখে। সংশ্লিষ্টদের মতে, কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে প্রতারক চক্রের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরে ঢাকা ডেন্টাল কেয়ারের সামনে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ডেন্টাল ক্লিনিক। যার মধ্যে বৈধ ক্লিনিক ১০টির বেশি নয়। নিয়ম অনুযায়ী বৈধ ক্লিনিকের মধ্যেও অনেকের নেই বিডিএস চিকিৎসক ও দক্ষ টেকনিশিয়ান। আবার অন্য ক্লিনিক ও ব্যক্তিগত চেম্বারগুলোতে যারা চিকিৎসক হিসেবে আছেন, তারা প্রত্যেকেই চিকিৎসা দেওয়া থেকে শুরু করে দাঁত তোলা, অস্ত্রোপচারসহ সবই করছেন। অভিযোগ রয়েছে, ডিগ্রি নেই কিন্তু তারপরও অনেকেই নিজেকে ডাক্তার, ডেন্টিস্ট, ডেন্টাল সার্জন, কনসালটেন্ট পরিচয় দিয়ে কিংবা ভুয়া সনদ নিয়ে ক্লিনিক খুলে রমরমা ব্যবসা করছেন। এসব ক্লিনিকের সাইনবোর্ডে ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাম লেখা থাকলেও কার্যত চিকিৎসায় সেসব ডাক্তারের সন্ধান মেলে না। বিভিন্ন ডাক্তারের সঙ্গে থাকা টেকনিশিয়ানরা এসব ক্লিনিকের প্রকৃত মালিক ও চিকিৎসক বলে জানা গেছে। ডি.ডি.টি.ডি.বি, কে.পি। এটা কী ধরনের ডিগ্রি তা কেউ না জানলেও এমন বিশেষায়িত ডিগ্রি ব্যবহার করে দিনের পর দিন দাঁতের সব জটিল রোগের চিকিৎসা করছেন এমন একজন চিকিৎসক যিনি কোনো মেডিকেলে পড়াশোনা করেননি। পড়াশোনা না থাকলেও তিনিই হয়ে গেলেন রাজধানীর খ্যাতিমান দন্তবিশেষজ্ঞ। নাম তার আক্তার হোসেন। শুধু তিনি একা নন। তার মতো অসংখ্য দন্ত বিশেষজ্ঞ রয়েছেন রাজধানীসহ সারা দেশে। র‌্যাব এমন এক চিকিৎসককে আটকও করেছিল। আকতার হোসেনের রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকায় ছিল চেম্বার। এসব চেম্বারে প্রতিদিন রোগী আসত শত শত। ইচ্ছে করলেই এসব বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নাগাল মেলে না। আগে থেকেই বুকিং দিতে হয়। নাম ঠিকানা লেখাতে হয়। ফিও বেশ চড়া। পাঁচশ টাকা। বিশেষজ্ঞের চেম্বারে গিয়ে কোনো রোগী যখন অপেক্ষায় থাকেন তখন শোনানো হয় অনেক চটকদার কথা। যেমন ডাক্তার আক্তার হোসেনের নাগাল পাওয়া বেশ কঠিন। উনি খুব একটা রোগী  দেখেন না। যারা সাত দিন আগে থেকে বুকিং দেন কেবল তাদেরই বিশেষ বিবেচনায় আর মানবিক কারণে দেখেন। দাঁত ওঠানোর ব্যাপারে একজন রোগী মারুফ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বলেন, দাঁতের ব্যথা নিয়ে তিনি সেখানে যান। ডাক্তার আক্তার হোসেন দাঁত দেখে বলেন এক্স-রে করতে হবে। এক্স-রে করার পর বলেন, দাঁত পোকায় খেয়েছে। এটা ফেলে দিতে হবে। না  ফেলে উপায় নেই। থাকলে বাকিগুলোতে পোকা ধরবে। ডাক্তার যদি এই বলেন, তাহলে আর না ফেলে উপায় কী। বাধ্য হয়েই শুয়ে গেলাম। তিনি বললেন, আপনাকে কিছু করতে হবে না। শুধু মুখটা হা করে চুপচাপ শুয়ে থাকুন। তারপর তিনি দাঁতের গোড়ায় একটা ইঞ্জেকশন পুশ করেন। হাতে থাকা একটা রেঞ্চ দিয়ে এক টানেই দাঁত ওঠিয়ে ফেললেন। রক্ত যাতে বের না হয় সে জন্য দাঁতের গর্তে গজ তোলা ঢুকিয়ে বললেন, ওঠে পড়ুন। এটা পাঁচ ঘণ্টা রাখবেন। এর মধ্যে কিছু খাবেন না। তিন দিন পর মারুফ ফের এলেন ওই চেম্বারে। এখন অবস্থা আরও জটিল। এক দাঁত ফেলার পর পাশের আরও দুই দাতে ব্যথা শুরু। বলার পর ডাক্তারের জবাব, ওই দুটোও ফেলতে হবে। তার এ কথায় ভরসা রাখতে পারলেন না মারুফ। তিনি চলে গেলেন ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন আগের দাঁত ফেলানোর সময় ভুল চিকিৎসা করা হয়েছে। এর জন্য খেসারত দিতে হচ্ছে। মারুফের মতো এমন শত শত রোগী এ ধরনের চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন। পরে র‌্যাবের কাছে অভিযোগ দেওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর