সোমবার, ৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ ব্যাংক জানাল দেউলিয়া আইন কতটা দেউলিয়া

খেলাপিঋণ দ্রুত আদায়ে এ আইনের প্রয়োগ আরও কার্যকর করা দরকার, মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রচলিত দেউলিয়া আইন ততটা কার্যকর নয়, যতটা কার্যকর অর্থঋণ আদালত আইন। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, ‘ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আদায়ে এবং খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩ কার্যকর রয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে এ আইনটির যথেষ্ট প্রয়োগ ও কার্যকারিতা থাকলেও দেউলিয়া আইন-১৯৯৭ এর কার্যকারিতা অনুরূপ নয়।’ খেলাপি ঋণ দ্রুততার সঙ্গে আদায়ের জন্য দেউলিয়াবিষয়ক আইনের প্রয়োগ আরও কার্যকর করাসহ আইনের কিছু বিষয় প্রায়োগিক করা দরকার বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বর্তমানে আমেরিকায় একটি বিধান কার্যকর রয়েছে যে, কোনো প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার আগে তার পাওনাদারদের সঙ্গে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে সমঝোতা চুক্তির সুযোগ নিতে পারে; এ সুবিধা নিয়ে আদালতের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠনের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। আদালত প্রদত্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠন করতে না পারলে তারা দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার জন্য পুনরায় আদালতে আবেদন করতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যরত দেউলিয়া আইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের জন্য এ ধরনের সুযোগ রাখা গেলে দেউলিয়া আদালত আইন আরও কার্যকর হবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।  বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ কথা ঠিক, বাংলাদেশে দেউলিয়া আইনের প্রয়োগ ও কার্যকারিতা খুব একটা নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়, তারপরও দেউলিয়া ঘোষণা করতে চায় না। কারণ, এ আইনে অনেক ‘রেস্ট্রিকশন’ রয়েছে। দেউলিয়া ঘোষণার পর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আর সুবিধা পায় না।’ আমেরিকার অনুরূপ আইনে দেনাদার ও পাওনাদারের সমঝোতা কার্যকরের সুযোগ রেখে বিধান সংযুক্ত করার বিষয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, দেউলিয়া দোহাই দিয়ে, সমঝোতার সুযোগ নিয়ে ঋণগ্রহীতা যদি বছরের পর বছর পার করে দেয়, ঋণ পরিশোধ না করে তবে সেটি কার্যকর কোনো সংশোধন হবে না। এ জন্য এ ধরনের সমঝোতার বিষয়টি হতে হবে নির্দিষ্ট সময় এবং শর্তসাপেক্ষ। তাহলেই এ থেকে সুফল মিলবে। ক্ষমতাসীন সরকারের ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ বাস্তবায়নে যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত এ আইনটি সম্পর্কে এ ধরনের পর্যালোচনা দেয়। গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। দেউলিয়াবিষয়ক আইন বাস্তবায়নে আরও যেসব কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাওনাদারদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে দেউলিয়া আইনের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। অর্থঋণ আদালত কর্তৃক দেওয়া চূড়ান্ত রায়/ডিক্রির আদেশ দেওয়ার পর ঋণ দায় পরিশোধের যে সময় আদালত দিয়ে থাকে (সাধারণত ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধের আদেশ দেওয়া হয়) ওই সময়ের মধ্যে কোনো দেনাদার অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে অর্থঋণ আদালত দেউলিয়া আদালতে ওই রায়/ডিক্রির একটি কপি পাঠাতে পারেন। যাতে কপি পাওয়ার পর দেউলিয়া আদালতের জজ দেউলিয়া দেনাদারকে দেউলিয়া ঘোষণার সুযোগ পান। এ বিধান রেখে অর্থঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়া আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান সংশোধন করা দরকার বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।  কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও মনে করছে, দেউলিয়া আইন বাস্তবায়ন এবং এর উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় স্বতন্ত্র দেউলিয়া আদালত প্রতিষ্ঠা করা দরকার এবং এ ধরনের আদালতে দেউলিয়া সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অন্য কোনো মামলা চালাবে না, সে বিধানও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মতে, এভাবে গঠিত আদালতের তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট জেলার খেলাপি গ্রাহকদের (বিশেষত যাদের বিরুদ্ধে আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অর্থ আদায়ের মামলা হয়েছে) ঋণ গ্রহণ সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষিত রাখাসহ বিশেষ মনিটরিংয়ের বিধান দেউলিয়া আইনে রাখা যেতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ প্রস্তাবটিকে বাস্তবসম্মত বলে মনে করেননি ড. সালেহউদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রতি জেলায় দেউলিয়া আদালত প্রতিষ্ঠার মতো প্রয়োজনীয় জজ নেই। তাছাড়া জেলায় জেলায় এ ধরনের আদালত প্রতিষ্ঠারও দরকার নেই বরং প্রতি জেলায় অর্থঋণ আদালত ও দেউলিয়া আদালতের মামলাগুলো দেখার জন্য পৃথক বেঞ্চ গঠন করা যেতে পারে। যারা সপ্তাহে একদিন বা দুই দিন শুধু সেই মামলাগুলো দেখবেন।

সর্বশেষ খবর