মঙ্গলবার, ৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

কাটা লাশ কানে হেডফোন

মির্জা মেহেদী তমাল

কাটা লাশ কানে হেডফোন

বনানী রেললাইনের ওপর খন্ড বিখন্ড লাশ। নিচের অংশ একদিকে, ওপরের অংশ আরেকদিকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। খন্ডিত লাশ ঘিরে লোকজনের ভিড়। আশ্চর্য! তখনো হেডফোন একটি কানে গোঁজা অবস্থায় রয়েছে। আসে পুলিশ। লাশের খন্ডিত অংশগুলো উদ্ধার করে পাঠায় মর্গে। একটু আগেও যুবকটি হেডফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কখন যে পেছন থেকে ট্রেন চলে এসেছে, টেরই পাননি। হেডফোনে কথা বলে চরম পরিণতি বরণ করতে হয়েছে তাকে। জলজ্যান্ত এক যুবক নিমেষেই কয়েক টুকরায় পরিণত হলেন। ঘটনাটি কয়েকদিন আগের। তবে এমন ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রেনে মানুষ কাটা পড়ার ৪০ ভাগই ঘটছে হেডফোনে কথা বলার কারণে। বিগত এক বছরে ফাঁকা রেললাইন ধরে কথা বলতে বলতে প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। যাদের কাছে হেডফোন পাওয়া যায়।

ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন ফারুক মজুমদার বলেন, এটি এখন একটা বড় সমস্যা। কানে হেডফোনে লাগিয়ে কথা বলতে থাকে, হাঁটতে থাকে রেললাইনের ওপর দিয়ে। কখনো হাসছে, কখনো নাচছে। আশপাশে কী হচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। আনমনে হেঁটে চলেছে রেললাইন ধরে। ট্রেনের বিকট হুইসেলও তাদের কানে পৌঁছায় না। একপর্যায়ে ট্রেন চলে যায় তাকে পিষ্ট করে। কাটা পড়ে দেহ। খ-বিখ- দেহ পড়ে থাকে রেললাইনের পাশে। এমন করুণ মৃত্যু বেশ কয়েক বছর ধরে অহরহ ঘটছে। তার পরও অসচেতন মানুষ। হেডফোন লাগিয়ে আনমনা হাঁটতে গিয়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

কানে হেডফোন লাগিয়ে ক্যান্টনমেন্টের স্টাফ রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ২০ বছরের টগবগে যুবক রায়হান হোসেন। রেললাইন ধরে বেখেয়ালে হাঁটছিলেন। এ সময় পেছন থেকে হুইসেল দিতে দিতে ছুটে আসে কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস। নিশ্চিত মৃত্যু জেনে দূর থেকে মানুষজনও চিৎকার করে ডাকছিল তাকে। ট্রেন আসছে, ট্রেন আসছে, সরে দাঁড়ান- এ চিৎকারও তার কানে পৌঁছায়নি। চোখের সামনে তরতাজা যুবক রায়হান ট্রেনে কাটা পড়েন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। এভাবেই অর্ধশতাধিক মায়ের বুক খালি হয়েছে। হেডফোন কেড়ে নিয়েছে এসব পরিবারের স্বপ্ন। কেউ হয়েছেন বিধবা, কোনো সন্তান হয়েছে পিতৃহারা। এমন আরও ঘটনা ঘটে সাম্প্রতিক সময়ে। ভৈরব থেকে ছেড়ে আসে ঢাকাগামী একটি ট্রেন। ট্রেনটি নরসিংদী স্টেশনে থামার জন্য আরশিনগর অতিক্রম করছিল। ঠিক তখনই তাড়াহুড়া করে রাস্তা পার হচ্ছিলেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার সৈয়দনগর চরসিন্দুর এলাকার বাসিন্দা মোবারক মিয়া। একই সঙ্গে রাস্তা পার হতে চান অজ্ঞাতনামা আরেক মহিলা। কিন্তু রেললাইন তারা পার হতে পারেননি। দুজনকেই কেটে সবার সামনে দিয়ে চলে যায় ট্রেন। তাদের দুজনের রক্তে লাল হয় রেললাইনের সাদা পাথর। কয়েক টুকরা হয় তাদের দেহ। চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি কলেজের প্রফেসর ওয়াজিউল্লাহ বেড়াতে আসেন ঢাকায়। নববিবাহিত ওয়াজিউল্লাহ ওঠেন তেজকুনিপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাসায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন। নববধূর সঙ্গে হেডফোনে কথা বলতে বলতেই ট্রেনের নিচে চলে যান। দেহ টুকরো হয়ে রেললাইনের দুই পাশে পড়ে থাকে। এমন বেখেয়ালে রেললাইন ধরে হাঁটা বিপজ্জনক জেনেও মানুষ হাঁটছে। অকালে মারা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রায়ই শোনা যায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা। গত ফেব্রুয়ারিতে কমলাপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত রেললাইনেই কাটা পড়ে মারা গেছেন ১০ জন। সর্বশেষ গতকাল রাজধানীর বিমানবন্দর ও ক্যান্টনমেন্টের মধ্যবর্তী এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাতনামা পুরুষ (৪০) নিহত হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেললাইন ধরে কিংবা এর দুই পাশে ১০ ফুট করে ২০ ফুটের মধ্যে হাঁটা সম্পূর্ণ অবৈধ ও দ নীয়। ব্রিটিশ আমলের (১৮৬১ সাল) আইনের ১২ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে- রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া অন্য কেউ এমনকি গবাদিপশুরও প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যেখানে রেললাইনের ২০ ফুট এলাকার মধ্যে প্রবেশই নিষিদ্ধ এবং রয়েছে গ্রেফতারের বিধানও সেখানে প্রবেশ করা মানুষকে গ্রেফতার দূরের কথা রেললাইনেই বসছে হাটবাজার। ওই আইন অনুযায়ী লাইনের দুই পাশের ২০ ফুট এলাকায় সবসময়ই স্থায়ীভাবে ১৪৪ ধারাও জারি থাকে। অথচ হাজারো মানুষের মৃত্যু ঘটলেও আদৌ কাউকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অপরাধে গ্রেফতার করার নজির দেখাতে পারছে না রেলওয়ে। পারছে না ২০ ফুট এলাকার মধ্যে গড়ে ওঠা অবৈধ হাটবাজার উচ্ছেদ করতে। আইনের প্রয়োগে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ঢিলেঢালা অবস্থানের কারণেই দিনের পর দিন রেললাইনে কাটা পড়ছে হাজারো মানুষ।

 ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু রোধে কাজ করছে ঢাকা রেলওয়ে থানা। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত মাইকিং করা হয়েছে। এ ছাড়া লিফলেট বিলি করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানেও একই কাজ করে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তার পরও ট্রেনে কাটা রোধ করা যাচ্ছে না। তবে এসব ঘটনায় অনেক সময় অপমৃত্যু মামলা করা হয় আবার বছরে একটি-দুটি হত্যা মামলাও করা হয়। আমাদের এখানে হত্যা মামলার সংখ্যা খুবই কম। আর যে দু-একটি মামলা আছে তার তদন্ত কার্যক্রম খুব দ্রুতই শেষ করা হচ্ছে। ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইয়াসিন ফারুক মজুমদার বলেন, ট্রেনে কাটা পড়ে দেশের সব জায়গায়ই মানুষ নিহত হচ্ছে। এর জন্য সচেতনতা দরকার। কারণ, অসাবধানতার কারণেই এসব ঘটছে। তবে এসব অসাবধানতার জন্য তিনি অবৈধ রেলক্রসিং, অবৈধ স্থাপনা, রেললাইনের ওপর হাটবাজার, হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন দিয়ে রাস্তা পার হওয়াসহ আরও কিছু কারণ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু রেললাইন দিয়ে যারা চলাচল করেন তারা যদি সচেতন না হন তাহলে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যাবে না।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর