বুধবার, ৬ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

সিটির ৫৪ উন্নয়ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা

চুড়িহাট্টা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের তদন্ত প্রতিবেদন পেশ, কেমিক্যালেই ছড়িয়েছে আগুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানী ঢাকার উন্নয়নে নিয়োজিত ৫৪টি উন্নয়ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণেই ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। এই সংস্থাগুলোর জন্য বিদ্যমান আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে বহুদিন ধরে পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল ব্যবসা চলে আসছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাতও হয়েছে ওয়াহিদ ম্যানশনের দ্বিতীয়তলার কেমিক্যাল থেকে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে এ কথা বলেছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি)। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবনে প্রচুর কেমিক্যাল থাকায়  বৈদ্যুতিক সুইচ অন করার সময় স্ফুলিঙ্গ বা অসাবধানতাবশত জ্বালানো আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা এড়াতে আট দফা সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এতে ৫৪টি সংস্থা উন্নয়নমূলক কাজ সমন্বয়ের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং রাজউকের অন্তর্গত ১ হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রণালয় স্থাপন করতে বলা হয়। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ওপর আইইবি তাদের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী নুরুল হুদাকে আহ্বায়ক এবং সহকারী সাধারণ সম্পাদক (একাডেমিক ও আন্তর্জাতিক) প্রকৌশলী কাজী খায়রুল বাশারকে সদস্যসচিব করে ২৩ ফেব্রুয়ারি ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- আইইবির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য প্রকৌশলী হামিদুল হক, প্রকৌশলী প্রফেসর ড. মুনাজ আহমেদ নুর, আইইবির তড়িৎকৌশল বিভাগের সদস্য প্রকৌশলী ড. ইয়াছির আরাফাত এবং কেমিকৌশল বিভাগের সদস্য প্রকৌশলী ড. কাজী বায়েজিদ কবির। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর দফতরে দাখিল করা প্রতিবেদনটির বিষয়ে আইইবির সাধারণ সম্পাদক (সম্মানী) খন্দকার মনজুর  মোর্শেদ জানান, প্রতিবেদনে আগুন লাগার কারণ বর্ণনা এবং কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বা আমলে নিলে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলে মনে করেন তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে  : সিসিটিভির ফুটেজ ও মোবাইল ক্যামেরার কিছু ভিডিওতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেখে অনেকেই দাবি করেছে, আগুন ওয়াহিদ ম্যানশনের বাইরে থেকে শুরু হয়ে ভবনে ছড়িয়েছে। মসজিদের পাশের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে এয়ার ফ্রেশনারের ক্যান এসে পড়ছে রাস্তার ওপর। তাতে আপাতদৃষ্টিতে আগুন ওয়াহিদ ম্যানশনের দ্বিতীয়তলা থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণে অতিদাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন লাগার পর বিস্ফোরণে দেয়াল ভেঙে পড়েছে এবং অভ্যন্তরীণ দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। তবে ভিতরের দিকে অক্সিজেনের সরবরাহ কম থাকায় আগুন সেদিকে বাড়তে পারেনি। এজন্য ওয়াহিদ ম্যানশন সংলগ্ন ওয়াহিদ মঞ্জিলের কোনো ক্ষতি হয়নি। তার বদলে আগুন রাস্তার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিপরীতমুখী নানা তথ্য থাকায় ঘটনাস্থলের পরিপূর্ণ ফরেনসিক তদন্ত প্রয়োজন।

তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ওয়াহিদ ম্যানশনের আশপাশের এলাকা পরিদর্শনের সময় দেখা গেছে সেখানে ডিপিডিসির বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ছিল না। বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনেও শর্টসার্কিটের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ট্রান্সফরমার যেখানে ছিল, সেখানে তা অক্ষত রয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনও অক্ষত ছিল। প্লাস্টিকদানা নেওয়ার জন্য যে পিকআপটি ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল, তা ডিজেলচালিত। আরেকটি পিকআপ/মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াহিদ ম্যানশনের দ্বিতীয়তলায় বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী ভস্মীভূত ও প্রায় অক্ষত অবশিষ্টাংশ দেখা যায়। এর মধ্যে যেসব সামগ্রীর লেবেল অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে, বাদামের তেল, রেড়ীর তেল, অলিভ অয়েল, এয়ার ফ্রেশনার ও সুগন্ধি। এ ছাড়া আরও কিছু প্রসাধনীও অক্ষত ছিল।

ওয়াহিদ ম্যানশনের দ্বিতীয়তলায় প্রসাধনী সামগ্রী মজুদ ছাড়াও খালি ক্যানে পারফিউম, এয়ার ফ্রেশনার রিফিল করা হতো। এগুলো উদ্বায়ী ও দাহ্য পদার্থ। পারফিউমের অন্যতম উপাদান ইথানলের ফ্ল্যাশ পয়েন্ট ১৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এয়ার ফ্রেশনারের ক্যানে প্রোপিল্যান্ট (Propellant) হিসেবে এলপিজি ব্যবহৃত হয়। বাতাসে এয়ার ফ্রেশনারের ঘনত্ব আনুমানিক শতকরা একভাগ হলেই তা দাহ্যতার নিম্নসীমা অতিক্রম করে এবং স্ফুলিঙ্গের উপস্থিতিতে আগুন ধরে বিস্ফোরণ হতে পারে। এলপিজি সাধারণত নিচু ও বন্ধ জায়গায় জমা হয়। জমাটবাঁধা এলপিজি অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসামাত্র ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

আগুনের তীব্রতা, বিস্ফোরণ ও ছড়িয়ে পড়ার মুখ্য কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে দ্বিতীয়তলায় থাকা দাহ্য প্রসাধনী ও অন্যান্য সামগ্রীর বিপুল মজুদ।

পর্যবেক্ষণ  : রাজধানীতে ৫৪টি সংস্থা উন্নয়নমূলক কাজ করলেও তাদের কর্মকাে  রয়েছে সমন্বয়ের অভাব। অনেক সংস্থার কর্মপরিধির মধ্যে দ্বৈধতা রয়েছে। এতে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। এই সংস্থাগুলোর কর্মকা  মনিটরিংয়ের জন্য একক কোনো মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিয়োজিত নেই। ফলে বছরব্যাপী খোঁড়াখুঁড়িসহ বিভিন্ন কর্মকা  পরিচালিত হয়। সংস্থাগুলোর জন্য যেসব আইন ও বিধি রয়েছে সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই বিধায় পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের ব্যবসা বহুদিন ধরে চলছে, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

সুপারিশ : সুপারিশের অংশে কমিটি উল্লেখ করেছে, আইন ও বিধির অসামঞ্জস্যতা অবসানে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করা একান্ত প্রয়োজন। সেই কমিটির মাধ্যমে সংস্থাগুলোর সব আইন ও বিধির সমন্বয় করে নতুন একটি সমন্বিত আইন ও বিধি প্রণয়ন করা। যার যার কর্মপরিধি অনুযায়ী সমন্বিতভাবে কার্য সম্পাদন করা ও কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করা। এই কাজগুলোর সমন্বয়ের জন্য সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কাছে দায়িত্ব দেওয়া যায়। প্রয়োজনে দুই সিটিসহ রাজউকের অন্তর্গত এক হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এতে আরও বলা হয়েছে, পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো অত্যন্ত সরু এবং সড়কগুলো যানবাহন চলাচলের অযোগ্য। এই এলাকার বাসিন্দাদের পর্যায়ক্রমে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে নতুনভাবে পরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন কেরানীগঞ্জ বা সাভারে কেমিক্যাল পল্লী গঠনের মাধ্যমে দাহ্য পদার্থের গুদাম সরানোর ব্যবস্থা করা। কেমিক্যাল ব্যবসায়ী, গুদামজাত ও পরিবহনে নিয়োজিত সবাইকে কেমিক্যাল ব্যবহার ও সংরক্ষণের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে অবহিত করা এবং তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিস্ফোরক দ্রব্যাদির আমদানি, মজুদ, বিতরণ ও ব্যবহারের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনসিসি) এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করা। রাজউক ও সিটি করপোরেশন আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

সর্বশেষ খবর