শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

খাদ্য নয় বিষ

মির্জা মেহেদী তমাল

খাদ্য নয় বিষ

ধানমন্ডির বাসিন্দা খায়রুল আনাম। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। তার স্কুল জীবনের বন্ধু খোকন আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছে। খায়রুল তার ধানমন্ডির বাসায় তাকে দাওয়াত করেছে। সঙ্গে আরও ৩ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রাতে খাবারে গরু, মুরগি, মাছ ছাড়াও নানা পদের তরকারি ছিল। খায়রুলের স্ত্রীর হাতের রান্না। একসঙ্গে পাঁচ বন্ধু বেশ আয়েশ করে খেল। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে তারা তাদের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে করছিল।

খাবার শেষ করে তারা আড্ডায় বসে। কিন্তু অল্প কিছু সময় পরেই ব্যবসায়ী বন্ধু রোমেল চলে যেতে চাচ্ছে। কথা ছিল অনেক রাত পর্যন্ত তারা আড্ডা দিবে। কিন্তু রোমেল কিছুই শুনতে চাচ্ছে না। তার শরীর খারাপ লাগছে। বমি বমি লাগছে। আড্ডার সময়েই সে একবার টয়লেটে ঘুরেও এসেছিল। হঠাৎ কেমন যেন লাগছে তার। তাকে কেউ আটকালো না। বাসা কাছেই। রোমেল   চলে যায়। এরপর খোকন বলে, তারও পেট কেমন করছে। হয়তো দীর্ঘদিন পর দেশের খাবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। এ কারণে পেটে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন আরেক বন্ধুও একই কথা বলতে শুরু করল, তখন তারা আতঙ্কে। বলে কি? খায়রুল লজ্জা পাচ্ছে। তার বাসার খাবার খেয়ে কি এমন শরীর খারাপ করল। সেদিন আর আড্ডা হলো না। খায়রুলের মন খারাপ। বন্ধুদের বিদায় দিল।

ঘরে রান্না করা খাবার খেয়ে তারা ৫ বন্ধুই সেদিন বিছানায় পড়ে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। তবে চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। একজনকে থাকতে হয় সাত দিন। তার জীবনই সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছিল। খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছে। খায়রুলও ভাবছিল কেন এমন হলো। তার মনে পড়ল ধানমন্ডির একটি সুপার শপের কথা। যে সুপার শপ থেকে সেদিনকার দাওয়াতের মেনুর গরু, মুরগি আর মাছ কিনেছিল। খায়রুল নিশ্চিত হয়, সুপার শপের মাংস আর মাছ ছিল পচা। হয়তো রান্না করার সময় তা টের পায়নি তার স্ত্রী।

জীবন বাঁচাতে মানুষ খাদ্য গ্রহণ করে। কিন্তু সেই খাদ্য গ্রহণ করেই জীবন হয়ে উঠেছিল সংকটাপন্ন। যদিও এমন ঘটনা এখন আর নতুন কিছু নয়। মানুষ সময় বাঁচানো আর বাজারের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে সুপার শপে যায় বাজারের সদাই কিনতে। সুপার শপগুলো হালে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই সুযোগে সুপার শপগুলো এখন আর সামগ্রীর মান ধরে রাখছে না। বিশেষ করে পচা বা মেয়াদোত্তীর্ণ মাছ-মাংস বিক্রি হচ্ছে দেদার। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব সুপার শপে অভিযানও চালিয়েছে। আটক করেছে বস্তায় বস্তায় পচা মাংস ও মাছসহ অন্যান্য সামগ্রী। সংশ্লিষ্টরা বলছে, এসব পচা মাংস আর খাদ্যের মধ্যে ছিল না। পরিণত হয়েছিল বিষে।

গত সপ্তাহে রাজধানীর নামি-দামি বিভিন্ন সুপার শপ ও ২৬৮টি রেস্টুরেন্টে পচা মাংস খুঁজে পায় র‌্যাব। ওইসব প্রতিষ্ঠানে পচা মাংস সরবরাহ করার চালানপত্র র‌্যাব জব্দ করেছে। মেয়াদোত্তীর্ণ পচা মাংস সংরক্ষণের অভিযোগে হিমাগার ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ১৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেওয়াসহ মোট ২৮ জনকে জরিমানা করে র‌্যাব।

র‌্যাবের এসব অভিযানে অংশ নেওয়া প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তা ডা. এমদাদুল হক এ প্রতিবেদককে জানান, সুপার শপ আর নামি-দামি রেস্টুরেন্টে কী মাংস সরবরাহ করা হয় তা বলে বুঝানো যাবে না। হিমাগারে গিয়ে দেখা গেছে ভয়াবহ দৃশ্য। বেশি মুনাফার আশায় আমদানিকারক বিদেশ থেকে এসব নিয়ে আসে। একই কারণে সুপার শপ ও হোটেলগুলোও বিক্রি করে। 

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, জব্দ মাংসগুলোর নিয়মিত ছিল স্বপ্ন, মীনাবাজার ও ডেইলি শপিংসহ নামিদামি প্রতিষ্ঠান। আমদানিকারকদের কাছে পাওয়া কাগজপত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চলতি বছরের গত ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি হিমাগার থেকে ওইসব প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ হয়েছে মাংসগুলো। এগুলোর মধ্যে ইথিওপিয়া থেকে আসে দুম্বার মাংস, ভারত থেকে মহিষের, ইরাক থেকে খেজুর, অস্ট্রেলিয়া থেকে ভেড়ার মাংস, ব্রাজিল থেকে মুরগির মাংস, ভিয়েতনাম থেকে আনা হয় চিংড়ি ও কোড়াল মাছ। আর জব্দ হওয়া মাংসগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বরে গরুর মাংস, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এবং ২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল মুরগির মাংস, ২০১৮ সালের ডিসেস্বরে দুম্বার মাংসের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ ছাড়া ২০১৮ তে শেষ হয় জব্দ হওয়া খেজুরের মেয়াদ, ২০১৭ তে কিশমিশ এবং ডিসেস্বরে মেয়াদ শেষ হয় চকলেট ও চকলেট মিল্কের।   

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর