মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বোকা গ্রুপ কিন্তু বোকা নয়

মির্জা মেহেদী তমাল

বোকা গ্রুপ কিন্তু বোকা নয়

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আমিনুল ইসলাম। বনানীতে তার বাসা। সেদিন তার খুব তাড়াহুড়ো। অফিসে যেতে হবে। বাসা থেকে বেরিয়েই দেখতে পান, এক ব্যক্তি তাকে দেখে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। লুঙ্গি পরা আর ময়লা শার্ট। দেখতে সহজ-সরল। তাকে সালাম দিয়ে লুঙ্গিতে গুঁজে রাখা মোড়ানো ঠোঙ্গা বের করল। ঠোঙ্গার মধ্যে রাখা কিছু কাগজ বের করে আমিনুলকে দেখায়। বলে, স্যার এগুলা কী? দেখতে কেমন টাকার মতো লাগে। আমিনুল হাতে নিয়ে কাগজগুলো দেখেই বলে, আরে এগুলা তো সৌদি রিয়াল! লোকটি ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বলে, স্যার কী কইলেন? এইটা কি জিনিস কইলেন। তখন আমিনুল তাকে বলে, এটা টাকা। তবে সৌদি আরবের টাকা। এটার মূল্য আছে। তুমি পেলে কোথায়? লোকটির জবাব, স্যার এটা পড়ে পাইছি। আমার কাছে তো আরও আছে। আমি এগুলা কী করুম। বউ বলতেছিল, এগুলা পুলিশ দেখলে ধইরা নিয়া যাইব। যেখানে পাইছো সেইখানে ফালায়া দিয়া আসো। আমি ভাবতেছি কী করুম। ফালাইতে গেলে যদি পুলিশ আমারে ধইরা নেয়। আর এগুলা দিয়া আমি কী করুম স্যার। আমিনুল বলে, এগুলা ভাঙানো যায়। এগুলা দিলে তুমি অনেক টাকা পাবা। এ কথা শুনে লোকটির মুখে হাসি আসে। তাই নাকি স্যার! অনেক টাকা পামু? লোকটির চেহারা দেখে আমিনুলের মায়া লাগে। কী সুন্দর একটা হাসি দিয়েছে। তখন আমিনুল তাকে বলে, টাকা ভাঙানোর দোকানে গেলে তারা এগুলা রেখে টাকা দেবে। তখন লোকটি বলে, স্যার আমি চিনি না জানি না। কই যায়া বিপদে পরুম। আমি গরিব মানুষ। বউ বাচ্চারা না খায়া মারা যাবে আমার কিছু হলে। আমিনুলের তাড়াহুড়ো। তাকে বলল, আচ্ছা তুমি বিকালে এসো এখানে। আমি তোমাকে দেখি কী উপকার করতে পারি। তখন লোকটি বলে, স্যার আমার অত টাকার দরকার নাই। কম দামে হইলেও আমি দিয়া বাঁচি। লোকটি তার লুঙ্গির কোঁচ থেকে আরও একটি কাগজের পোঁটলা বের করে আমিনুলের হাতে দেয়। আমিনুল এতগুলো রিয়াল দেখে বুঝতে পারে না কী করবে। আমিনুল তাকে বলে, আমার কাছে এত টাকা এই মুহূর্তে নেই। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি চল আমার সঙ্গে। আমি দেখি কত টাকা আসে। আমি বুথ থেকে টাকা তুলে দিচ্ছি। লোকটিকে নিয়ে গুলশান যায় আমিনুল। তার কাছ থেকে ২০ রিয়ালের একটি নোট নেয়। নোটটি নিয়ে সে তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখে আমিনুল। এই সুযোগে আমিনুল একটি মানি এক্সচেঞ্জের দোকানে যান। সেখানে গিয়ে রিয়ালের নোটটি ভাঙাতে বলে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পায়, রিয়ালটি জাল নয়। সঠিক আছে। এ কথা শুনেই আমিনুলের অস্থিরতা বাড়ে। তিনি তাড়াতাড়ি বের হয়ে লোকটির খোঁজ করে। লোকটি তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে। তার কাছ থেকে সবগুলো রিয়াল নেয় আমিনুল। তার কাছে কিছু টাকা ছিল, আরও কিছু বুথ থেকে তুলে মোট ৫০ হাজার টাকা তুলে দেয়। লোকটি টাকাগুলো পেয়ে কান্না করতে থাকে। বলে, স্যার জীবনে আমি এতগুলো টাকা দেখিনি। আপনার অনেক ভালো হোক। পায়ে ধরে সালাম করতে চায় লোকটি। পরে টাকাগুলো নিয়ে মানুষের ভিড়ে মিশে যায়। আমিনুল ভাবে, লোকটিকে ঠকানো হয়ে গেল নাকি? আবার নিজেই সান্ত্বনা নেয়, লোকটি তো রাস্তায় পড়ে পেয়েছে। যা পেয়েছে তাই লাভ। বরং আসল টাকা পেলে কী করবে না করবে টাকা দিয়ে। বিপদও হতে পারে। বরং টাকাগুলো তার সঠিক কাজেই লাগবে। তিনি আস্তে-ধীরে আবারও সেই মানি এক্সচেঞ্জে যায়। দুই হাজার রিয়াল ভাঙাতে বলে। আবারও পরীক্ষা চলে। এবার মানি এক্সচেঞ্জের লোকজন তাকে জানায়, এবারের পুরোটাই জাল। এগুলো জাল নোট। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দৌড়ে লোকটিকে খোঁজ করতে রাস্তায় ছুটে যায়। কিন্তু লোকটি ততক্ষণে হাওয়া। আমিনুল বুঝতে পারে, সে প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছে।

আমিনুলের মতো এভাবেই সাধারণ মানুষ এমন প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে টাকা-পয়সা খোয়াচ্ছে। এমন চক্র শুধু ঢাকাই নয়, সারা দেশেই সক্রিয়। গত রবিবার র‌্যাব এ ধরনের একটি চক্রেরও সন্ধান পায়। এদের হাতে কখনো ডলার, কখনো বা রিয়াল। টার্গেট ব্যক্তির কাছে গিয়ে না জানার ভান করে বলে, এগুলো কোন দেশের টাকা? এরপর জানতে চায়, কীভাবে বিদেশি মুদ্রাগুলো বাংলাদেশি টাকায় ভাঙানো যাবে। এভাবে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রতারণা করে আসা একটি চক্রের সাতজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। রাজধানীর ভাটারা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এই সাতজনের কাছ থেকে র‌্যাব জানতে পেরেছে তাদের নানা কৌশলের কথা। সংশ্লিষ্টরা বলছে, এরা বোকা গ্রুপ। তবে এই গ্রুপের সদস্যদের কেউ বোকা নয়। বোকার অভিনয় করে ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষকে। বনানীর আমিনুল রিয়াল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও প্রতারণার শিকার হয়েছে বোকা মানুষের ফাঁদে পড়ে।

 র‌্যাব জানিয়েছে, তারা প্রতারণা করার সময় বলত রিয়ালগুলো ইজতেমার মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছে বা কোনো বিদেশি পর্যটক তাদের দিয়েছেন। বিষয়টি সাধারণ মানুষও সরল মনে বিশ্বাস করত। প্রতারণার সময় এমন ভাব নিত যে তারা কিছুই বুঝে না। র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, চক্রটি বিভিন্নভাবে জনসাধারণকে ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করত। প্রতারকদের সবাই পেশায় রংমিস্ত্রি। তারা পেশার সুবাদে সহজেই মানুষের বাসায় প্রবেশ করতে পারত। কারও বাসায় ঢুকে বয়স্ক ব্যক্তিদের টার্গেট করত। তারা রিয়াল দেখিয়ে কমমূল্যে বিক্রি করার কথা বলে প্রলোভন দেখাত। আর ওই ব্যক্তি রাজি হলেই টাকার বিনিময়ে ওপরের কয়েকটি প্রকৃত নোট সরিয়ে রেখে ভিতরে কাগজ দিয়ে বানানো ব্যান্ডেল দিয়ে কেটে পড়ত। তিনি জানান, তারা যানজটে আটকে থাকা গাড়ির ব্যক্তিদের টার্গেট করে রিয়ালগুলো দেখাত। গাড়িতে থাকা ব্যক্তিরা স্বল্প সময়ে তাদের কথা বিশ্বাসও করত। রিয়ালগুলো যাচাই-বাছাই করার সময় পেত না তারা। ফলে স্বল্প সময়ে প্রতারণা করে নকল রিয়ালগুলো হাতে তুলে দিয়েই সটকে পড়ত চক্রটির সদস্যরা। চক্রটির সদস্যরা হজ ক্যাম্পের হাজীদের টার্গেট করে প্রতারণা করত। সেখানে গ্রাম থেকে আসা লোকদের ফাঁদে ফেলে এ পর্যন্ত লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। তবে এ চক্রের মূল হোতা আবু শেখের খোঁজ চলছে। তার নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে সাতজনের এ চক্রটি অভিনব পন্থায় প্রতারণা চালিয়ে আসছিল।

র‌্যাব জানায়, একটু সচেতন হলেই এসব প্রতারক চক্র তাদের ফাঁদ পাততে পারে না। মানুষ লোভে পড়ে, অল্প টাকায় বেশি লাভের আশায় এ ধরনের ফাঁদে পড়ছে নিয়মিত। এদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষায় নিজেদের সচেতন হতে হবে। এদের সন্ধান পেলেই পুলিশকে খবর দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর