বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

মৎস্য খাতে বিপ্লব

টেংরা, কৈ, পাবদা, মাগুর, শিং, চিতল, বাটা, মহাশোল কালবাউশসহ ১৯ প্রজাতির বাণিজ্যিক চাষাবাদ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মৎস্য খাতে বিপ্লব

বিলুপ্তির তালিকায় থাকা মিঠাপানির ১৯ প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল ও জিনপুল সংরক্ষণ এবং বাণিজ্যিক চাষাবাদে মৎস্য খাতে ঘটেছে বিপ্লব। নতুন উদ্ভাবিত অধিক প্রজননশীল এসব জাতের মাছ উৎপাদনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে অবস্থান পঞ্চমে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশের ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪ প্রজাতি বিলুপ্তির তালিকায়। বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষিদের বাণিজ্যিক চাষাবাদে উৎসাহিত করতে এর মধ্যে ১৯ প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল ও জিনপুল সংরক্ষণ এবং চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রজাতিগুলো হলো- টেংরা, গুতুম, পাবদা, গুলশা, মেনি, ফলি, দেশি সরপুঁটি, কৈ, শিং, মাগুর, গুজি, আইড়, বাটা, ভাগনা, গনিয়া, কালবাউশ, মহাশোল, চিতল এবং কুচিয়া। এ ছাড়া গবেষণার মাধ্যমে রুই এবং তেলাপিয়ার জাত উন্নয়নে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদে উৎসাহিত হয়েছে চাষিরা। দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনার জন্য এটি একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। দেশীয় মাছের জাত উন্নয়নের বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাছে-ভাতে বাঙালির ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদকে উৎসাহিত করা ছিল আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে জাত উন্নয়নে উন্মুক্ত ছিল সম্ভাবনার দুয়ার। প্রজনন কৌশল ও জিনপুল সংরক্ষণ এবং বাণিজ্যিক চাষাবাদে আমরা বেছে নিয়েছিলাম বিলুপ্তির তালিকায় নাম লেখানো এবং চাহিদা রয়েছে এরকম জাতের মাছ। বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টায় এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ চলছে এসব মাছের। তিনি বলেন, মৎস্য খাতে বিপ্লবের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আমাদের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চাষিদের উৎসাহিত করতে উন্নত জাতের পোনা সরবরাহ ও স্বল্পমূল্যে মাছের খাবার সরবরাহ করতে হবে। মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। এ খাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ। মৎস্য খাতে প্রতি বছর ৬ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। মৎস্য খাতকে অন্যতম লাভজনক খাত হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত দ্রুত বর্ধনশীল জাতগুলো। দেশীয় প্রজাতির এসব মাছের চাহিদা ব্যাপক থাকায় লাভের আশায় উৎসাহিত হচ্ছেন চাষিরা। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও তেলাপিয়া বিশেষজ্ঞ ড. এ এইচ এম কোহিনুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জেনেটিক গবেষণার মাধ্যমে ২০০৯ সালে দেশীয় রুই মাছের নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়। ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা দেশের বিভিন্ন নদীর উৎস থেকে রুই মাছের বন্যজাত সংগ্রহ করে ক্রস বিডিং পদ্ধতিতে জাত উন্নয়ন ঘটায়। উদ্ভাবিত এই জাতের রুই মাছ (প্রজন্ম ২) বিদ্যমান প্রজাতির চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি উৎপাদনশীল। তিনি আরও জানান, গবেষণার মাধ্যমে তেলাপিয়ার জাত উন্নয়নে বদলে গেছে মৎস্য খাতের চিত্র। নতুন উদ্ভাবিত তেলাপিয়া মাছ (প্রজন্ম-১১) এর বৃদ্ধি বিদ্যমান প্রজাতির চেয়ে ৫৩ শতাংশ বেশি। ময়মনসিংহে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান কার্যালয়ে চলছে মূল গবেষণা কার্যক্রম। এই কেন্দ্রের অধীনে আরও তিনটি উপকেন্দ্রে চলছে পোনার মানোন্নয়ন কার্যক্রম। সরেজমিন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরীক্ষামূলক পুকুরে দেখা যায়, বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে পুকুরে বেড়ে উঠছে টেংরা, পাবদা, কৈ, শিং, গুতুমসহ হারিয়ে যাওয়ার খাতায় নাম লেখানো মহাশোল মাছ। মাছের প্রজনন কৌশল ও জিনপুল সংরক্ষণ করে এসব উদ্ভাবিত প্রযুক্তি হস্তান্তর করা হচ্ছে মৎস্য অধিদফতরকে। সেখান থেকে চাষিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে সার্বিক সহায়তা দিয়ে চলছে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর