লালনে মাতোয়ারা কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়ি। বাউল সাধু বৈষ্ণবদের মেলা বসেছে লালনধামে। তারা গাইছেন মানুষের জয়গান। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের আখড়ায় শুরু হয়েছে তিন দিনের দোল উৎসব বা লালন স্মরণোৎসব। গতকাল সন্ধ্যায় এ উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও তার অনেক আগেই মানুষের মিছিল আসতে শুরু করে এই বাউল তীর্থে। সাঁইজির টানে এ ধামে বাউলর ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীর ভিড় লেগেছে।
এসো হে প্রভু নিরঞ্জন, মানুষ ছাড়া খ্যাপা রে তুই কুল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপানা তুমি, বাড়ির পাশে আরশিনগর- এ রকম অসংখ্য লালনসংগীতের সুরের মূর্ছনায় এখন মাতোয়ারা বাউলধাম। এ ছাড়া লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করছেন তার গাওয়া গান গেয়ে। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সুর মেলাতে ভুল করছেন না ভক্তরাও। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে হাজারো মানুষ সাঁইজির সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় দূরদূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন এ স্মরণোৎসবে। আউল-বাউল, সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দিওয়ানাদের পদভারে মুখর হয়ে উঠেছে সাঁইজিধাম। ধামের পাশে বিশাল মাঠের খোলা প্রান্তরে গুরু-শিষ্যের মিলনমেলায় মনের মানুষের সন্ধানে আকুল ভক্তদের চলছে নাচে-গানে দিনরাত ভাবের খেলা। ভাবগান আর বাউল আচারের যজ্ঞ পালন ছাড়াও বাউল পথ ও মতের দীক্ষাও নিচ্ছেন অনেকে। স্মরণোৎসব বা দোল উৎসব মানেই বাউল ফকিরদের মহাসম্মেলন।
এখানে আগত বাউলরা ভাবপরম্পরা বিনিময় করেন আপন মনে, নিজস্ব রীতিতে। লালন সাঁইজি জীবিত থাকাকালে ফাল্গুনের শেষে দোলপূর্ণিমা তিথিতে কালী নদীর তীরে শিষ্যদের নিয়ে রাতভর গান-বাজনা ও তত্ত্ব আলোচনা করতেন, যা কালক্রমে পরিণত হয়েছে লালন স্মরণোৎসবে বা দোল উৎসবে। ফরিদপুর জেলা থেকে আসা পঞ্চাশোর্ধ্ব বাউল নিজাম শাহ বলেন, ‘আমাদের কাছে দোলপূর্ণিমা মানে ভালোবাসার আলো। মানুষের মাঝে ভালোবাসা আর প্রেমের আলো ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের দোল উৎসবের লক্ষ্য।’ তিনি বলেন, ‘এ আলো সবার মধ্যেই ছড়িয়ে দিতে পারলে দূর হবে সমাজের সব অন্ধকার, হিংষা, হানাহানি।’ কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বাউল ফজল শাহ বলেন, ‘সহজ মানুষ খোঁজা আর ভজার কাজে দীক্ষা নিয়েছি। এ পথেই সারা জীবন কাটাতে চাই।’ আখড়াবাড়িতে কথা হয় বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার আলিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে এলে মানুষের আলাদা একটা রূপ চোখে পড়ে। মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্র শেখা যায়।’ আরেক দর্শনার্থী মানিকগঞ্জের বাসিন্দা সাইফুল হক বলেন, ‘লালনের গান তার দর্শন ধারণ করতে পারলে সমাজের হানাহানি-মারামারি রোধ করা সম্ভব।’