শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

লাল বড়িতে রক্তাক্ত পরিণতি

মির্জা মেহেদী তমাল

লাল বড়িতে রক্তাক্ত পরিণতি

রাজধানীর মধুবাজারের ভাড়াটিয়া টিপু মিয়া। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ইয়াবায় আসক্ত সন্তান মনিরের অত্যাচারে পুরো পরিবার অতিষ্ঠ। প্রতিদিনই তাকে নেশার টাকা দিতে হয়। না দিলেই মারধর ও ভাঙচুর চালায় ঘরে। একদিন টাকা না পেয়ে ঘরের সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। এমনকি টাকার জন্য নিজের ছোট বোনকে অপহরণ করে মা-বাবার কাছে ফোনে টাকা চায় সে। জানিয়ে দেয়, টাকা দিলেই মেয়েকে ফেরত দেওয়া হবে। ১৭ ঘণ্টা পর মাত্র এক হাজার টাকা দিয়ে ছেলের কাছ থেকে মেয়েকে মুক্ত করেন তিনি। ওয়ারীতে ছিনতাইকারীর ছোরার ঘায়ে খুন হন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র খন্দকার আবু তালহা। এ ঘটনায় আবদুর রহমান মিলন ও বেলাল হোসেন সবুজ নামে দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ দুই আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। বলেছে, ওরা ইয়াবায় আসক্ত। রাজধানীর দয়াগঞ্জে এক নারীর ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। হেঁচকা টানে ওই নারীর কোল থেকে পড়ে ছয় মাস বয়সের শিশু প্রাণ হারায়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় গ্রেফতার রাজীব আদালতে স্বীকারোক্তিতে বলেছে, সে ইয়াবায় আসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য সে বেপরোয়া হয়ে ছিনতাই করেছিল।

মহাখালীর আরজতপাড়ার একটি বাড়িতে বৃদ্ধা মিলড্রেড গোমেজ মিলু খুন হন। তার অসুস্থ স্বামী ৮০ বছরের অনীল গোমেজের সামনেই দুর্বৃত্তরা তাকে গলা কেটে খুন করে। এ ঘটনায় পুলিশ জামির, পারভেজ ও নাঈম নামের তিন তরুণকে গ্রেফতার করে। পরদিন তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, মহাখালী বস্তি এলাকার ওরা তিনজনই ইয়াবায় আসক্ত। মাদকের টাকার জন্যই ওরা অনীল গোমেজের বাসায় যায়। রাতভর বাড়ির ছাদে বসে ইয়াবা সেবন করে। সাতসকালে ওই বাসায় ঢুকে তারা মিলুকে হত্যার পর লুটে নিয়ে যায় মালামাল। এমন ঘটনা এখন বাংলাদেশের নিত্যদিনকার ঘটনা। সারা দেশে এমন নৃশংস ঘটনায় আঁতকে উঠে মানুষ। আর এসব ঘটনায় যারা ধরা পড়ছে, এদের বেশির ভাগ মরণঘাতী ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবার টাকা জোগাড় করতে বাসা-বাড়ি-রাস্তায় ছিনতাই ডাকাতি করছে। টাকা না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের পর্যন্ত খুন করে ফেলছে। আর খুনের ঘটনাগুলো নৃশংসতায় ভরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলোচিত এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবার প্রভাব। সম্প্রতি সংঘটিত অপরাধ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাদকের কারণে দুই শতাধিক হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। আর এর অর্ধেকেরও বেশি খুনের কারণ ইয়াবা সংশ্লিষ্ট। সুস্থ সবল মেধাবী শিক্ষার্থীরা পরিবারের অজান্তেই ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। টাকার অভাবে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইয়াবায় আসক্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অধিদফতরের কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্রে যারা চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই এখন ইয়াবায় আসক্ত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়াবায় আসক্তরা হেরোইনে আসক্তদের মতোই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ২০-২৫ বছরের তরুণরাই এই নেশার জগতে দ্রুত ঢুকে পড়ছে। নেশাসক্ত এসব তরুণ-তরুণী পরিবারের জন্যও অশান্তির বড় কারণ হয়ে উঠেছে।

অনেকে ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। ইয়াবায় আসক্ত কয়েকজনের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। মুগদা এলাকার আরশাদ আলী বলেন, আদরের সন্তান রশীদ কীভাবে যে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে বুঝতেই পারিনি। কলেজে যাওয়ার জন্য টাকা দিতাম। সেই টাকা দিয়ে সে ইয়াবা ও গাঁজা সেবন করত। ধীরে ধীরে সে পুরোমাত্রায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। কলেজে যাওয়া ছেড়ে দেয়। ঘরের এটা-ওটা চুরি হতে থাকে। টাকা না পেলেই সে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। এখন আর ঘরেই থাকে না। ৮-১০ দিন পর পর কোথা থেকে এসে হাজির হয় টাকার জন্য। মানসম্মানের ভয়ে টাকা দিয়ে বিদায় করে দিই। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সব ধরনের মাদকাসক্ত স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আলাদা স্বভাবের হয়ে থাকে। সেই আলাদা স্বভাবের একটি হলো অপরাধপ্রবণতা।

এ কারণে মাদককে বলা হয় অপরাধের মা (মাদার অব ক্রাইম)। তবে ইয়াবার উপাদান এমফিটামিন ভয়ঙ্কর ক্ষতি করে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু থাকে না। হ্যালুসিনেশন হয়। প্যারানয়েড ডিলুশন বা সন্দেহপ্রবণতা দেখা দেয়। ইয়াবাকে বলা হয় মাইন্ড অলটারিং ড্রাগস। এই মাদক সেবনে সাময়িক উদ্দীপনা বাড়ে, ঘুম কমে যায়, বিরক্তি বাড়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার প্রবণতা বাড়ে। যার ফলে হত্যা-নির্যাতনের মতো নৃশংস কাজ করছে ইয়াবাসেবীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, মাদকের সঙ্গে অপরাধের বড় সম্পর্ক রয়েছে। আর প্রচলিত মাদকই অপরাধের বড় কারণ। একেক সময় একেক ধরনের মাদক আসে। এখন ইয়াবার প্রাদুর্ভাব। ফলে ইয়াবার সরবরাহ কমানো বা ব্যবসা বন্ধ করা জরুরি। এতে অপরাধ অনেকটাই কমে আসবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর