বিএনপির সাবেক নেতা মেজর অব. আখতারুজ্জামান বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে যে সহিংসতা হয়েছে তা সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রতিটি দায়ী ব্যক্তিকে শনাক্ত করে ন্যায়সংগত বিচারের মুখোমুখি করা জনগণের সময়ের দাবি। তবে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে কোনো নিরীহ ও নিরপরাধ রাজনৈতিক কর্মী যেন হয়রানির শিকার না হয় সেদিকেও সজাগ থাকতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানান। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সাবেক এই সংসদ সদস্য এসব কথা বলেন। আখতারুজ্জামান বলেন, যুদ্ধ এবং বিপ্লবে একটি পক্ষ সরকার, সরকারি কোনো বাহিনী, সরকারের প্রশাসনের ওপর যে কোনো প্রকার আক্রমণ যেমন জায়েজ বা প্রথাসিদ্ধ তেমনি শত্রুপক্ষের বা সরকার তথা রাষ্ট্রের স্থাপনা ধ্বংস করা একইভাবে জায়েজ। তবে এই কাজগুলো করতে হলে যে বা যারা করবেন তাদের প্রথমেই সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে অথবা কেউ বা যারা নিজেদেরকে বিপ্লবী ঘোষণা করে সরকারের ওপরে আক্রমণ ও রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংসে লিপ্ত হবে। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সারা দেশে যেভাবে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির ওপর আক্রমণ করেছে বা তাদের কাজে বাধা দিয়েছে বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে এবং ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশে যে ধ্বংসাত্মক তান্ডব চালিয়েছিল তা কোনো ঘোষিত যুদ্ধ বা বিপ্লব ছিল না। একটি অজ্ঞাত গোষ্ঠী বা পক্ষ যেভাবে অনেকগুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করেছে তাও কোনো যুদ্ধ বা বিপ্লবের অংশ ছিল না। কিন্তু কোনো একটি গুপ্ত পক্ষ কোটা বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে একটি অঘোষিত যুদ্ধ চালানোর বা বিপ্লব ঘটানোর অপচেষ্টা করেছিল, যা খুবই নিন্দনীয় ও প্রতিবাদযোগ্য। যদি কোনো রাজনৈতিক দল সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চায় তাহলে তাতে জনগণের বাধা দেওয়ার কিছু নেই। সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনো যুদ্ধের জবাব সরকার নিজের মতো করে দিতে পারবে এবং সেখানে আক্রমণের পাল্টা আক্রমণ, গুলির বিপরীতে গুলি, ধ্বংসের বিপরীতে ধ্বংস, হত্যার বিপরীতে হত্যা চালাতেই পারবে। সেখানে জনগণ, ছাত্র, শ্রমিক নারী কোনো পক্ষ নয়, যদি না তারা প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ অবলম্বন করে। কিন্তু এই ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর ওপর আক্রমনে জনগণ অন্য কোনো পক্ষকে দেখতে পায়নি। একইভাবে বলা যায়, ধ্বংসাত্মক ঘটনা যদি কোনো বিপ্লব ঘটানোর জন্য ঘটানো হয়ে থাকে তাহলে সেই বিপ্লবের ডাক কাউকে না কাউকে দিতে হবে বা এর দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে। আর যদি ধ্বংসলীলাকে কোনো গণবিপ্লব হিসেবে কেউ আখ্যায়িত করতে চায় তাহলে সেই বিপ্লবের লক্ষ্য এবং সুস্পষ্ট নেতৃত্ব থাকতে হবে যার বা যাদের নেতৃত্বে জনগণ সংগঠিত বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে এসব ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপগুলোকে গণবিপ্লব বা গণযুদ্ধে বিস্ফোরিত করেছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবারের পরের বুধবার পর্যন্ত কেউ বৃহস্পতিবারের তথাকথিত গণযুদ্ধ বা গণবিপ্লবের দায় স্বীকার করে নেয়নি।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবারের তথাকথিত গণযুদ্ধ বা গণবিপ্লবে জনগণের কোনো সক্রিয় সম্পৃক্ততা দেখা যায়নি। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- এখন পর্যন্ত এই ধংসাত্মক কার্যকলাপের দায় কেউ স্বীকার করেনি। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, দেশের ভিতরের কোনো পক্ষই এই ধ্বংসাত্মক ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। তাই তর্কের খাতিরে আমাদেরকে ধরে নিতে হচ্ছে এই ধংসাত্মক কার্যের সঙ্গে কোনো বিদেশি পক্ষ দায়ী। তা যদি আমাদের কারও কারও বিশ্বাস হয়ে থাকে তাহলে এই ধংসাত্মক কার্যকলাপের ওপর সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রতিটি দায়ী ব্যক্তিকে শনাক্ত করে সুুষ্ঠু ও ন্যায়সংগত বিচারের মুখোমুখি করা জনগণের সময়ের দাবি।
আখতারুজ্জামান বলেন, সরকার ধংসাত্মক কার্যকলাপের রাজনৈতিক ফায়দা নিতেই পারে এবং অবশ্যই নেবে। তবে যারা সরকারকে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে দিতে না চায় তাহলে ওই সকল রাজনৈতিক পক্ষকে অবশ্যই প্রকাশ্যে ধংসাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো উচিত। ইতোমধ্যেই কোটা বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ধংসাত্মক কার্যকলাপের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই বলে মিডিয়ার সামনে ঘোষণা দিয়েছে এবং ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি কোনো দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এই ধরনের হীন ও ন্যক্কারজনক আত্মঘাতী গণ ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িত হতে পারে না।
তিনি বলেন, আমি অবশ্যই আওয়ামী লীগের বিরোধী এবং সরকারের পরিবর্তন চাই। তবে সেই পরিবর্তন হতে হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে কোনো রাজনৈতিক দলের সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন করার গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। আমি এও মনে করি কারও যে কোনো বিপ্লব করার অধিকার আছে। তবে সেই বিপ্লবের নেতৃত্ব ও লক্ষ্য সুস্পষ্ট হতে হবে। লক্ষ্যহীন ও বিক্ষিপ্ত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ কোনো বিপ্লব হতে পারে না। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে কোনো নিরীহ ও নিরপরাধ রাজনৈতিক কর্মীকে যেন হয়রানি করা না হয়। আমি যেমন প্রকাশ্যে কোটা তথা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে, আমি যেমন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের নিন্দা জানাচ্ছি, তেমনি বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মীও মন থেকে তাদের সঙ্গে নাই। হয়তো দলের পদ-পদবি রক্ষা করার জন্য কট্টর ও ভাইয়া গ্রুপের চাপে তাদের সঙ্গে থাকতে হয়। চাপে পড়া বিএনপির এসব নেতাকর্মীদের হয়রানি না করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাব এবং সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান বলেন, সৃষ্ট ঘটনার জন্য উভয়পক্ষই কমবেশি দায়ী। তবে সরকারকে বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সব বাহিনী ও তাদের সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও সাধুবাদ- অল্প সময়ে এবং বিনা রক্তপাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য। আগামীতে আরও সাবধান থাকতে হবে। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে আরও বেশি জনবান্ধব হতে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি দমন ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের স্বার্থের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে আরও বেশি সচেষ্ট হতে। মানুষ পরিবর্তন চায়। সেই পরিবর্তন কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সম্ভব তা নিয়ে ভাবতে হবে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই।