কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, সংঘাত, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নাশকতার মামলায় রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযান ও ব্লক রেইড অব্যাহত রয়েছে। গতকাল সারা দেশ থেকে আরও অন্তত ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ঢাকায় কোটা আন্দোলনে নাশকতার বিভিন্ন মামলায় ৫৪ আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন ঢাকার নিম্ন আদালত। এদিকে রাজধানীর সেতু ভবনে হামলার মামলায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ছয়জনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
গতকাল মেট্রোরেলে হামলার মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রশীদুল আলমের আদালতে আসামিদের উপস্থিত করা হয়। এরপর সেতু ভবনে হামলার মামলায় তাদের সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। অন্যদিকে রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ মামলায় এদিন রিমান্ডে যাওয়া অন্য আসামিরা হলেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সায়েদুল আলম বাবুল, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক ও এম এ সালাম।
গত ২৮ জুলাই ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মইনুল ইসলাম কাজীপাড়ার মেট্রোরেল স্টেশনে ভাঙচুরের মামলায় এ ছয় আসামির পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরও আগে পল্টন থানার মামলায় রিজভী ও বিটিভি ভবনে হামলার মামলায় গোলাম পরওয়ার পাঁচ দিনের রিমান্ডে ছিলেন।
কারাগারে নূর-স্বপন : এদিকে মেট্রোরেলে ভাঙচুরের মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়াও একই মামলায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য এবং গাজীপুর জেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি ড. মো. সামিউল হক ফারুকীকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। তারা প্রত্যেকেই দুই দফায় মোট ১০ দিন রিমান্ড ভোগ করেন।
কোটা আন্দোলনে নাশকতার বিভিন্ন মামলায় গতকাল আরও ৫৪ আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন ঢাকার নিম্ন আদালত। এ নিয়ে ডিএমপি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়া আসামিদের সংখ্যা দাঁড়াল ৩০২৩ জনে।
এর মধ্যে অন্তত কয়েক শ আসামি বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড ভোগ করেন। এদিকে আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭০টিতে।
রংপুরে ২২ মামলায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ২০৩ : গত ১৬ এবং ১৭ জুলাই কোটা আন্দোলনের নামে দুর্বৃত্তদের তান্ডবে রংপুর নগরী ধ্বংসস্ত‘পে পরিণত হয়েছে। এই তান্ডবের অর্থ জোগানদাতা হিসেবে প্রাথমিকভাবে চারজনকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। ওই চারজনকে পুলিশ খুঁজছে। তবে অর্থ জোগানদাতা চারজনের রাজনৈতিক পরিচয় ও নাম প্রকাশ করা হয়নি। পুলিশের সূত্র বলছে, অর্থের জোগানদাতাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। তান্ডবের ঘটনায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ২২টি। গ্রেপ্তার হয়েছেন ২০৩ জন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা রয়েছেন।
জানা গেছে, দুর্বৃত্তদের তান্ডবে নগরীর তাজহাট থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। এখানে কমপক্ষে ৩০টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ৩টি মামলা করে। আসামি করা হয়েছে কয়েক হাজারজনকে। এ ছাড়া নগরীর সেন্ট্রাল রোডে অবস্থিত ডিবি কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ অফিসের কয়েকটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ছাড়া আসবাবপত্র, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী ভাঙচুর করা হয়। সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ছাড়া পরিবার পরিকল্পনা অফিস, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ কার্যালয়, সমবায় মার্কেট, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। এসব ঘটনায় পৃথক-পৃথকভাবে এ পর্যন্ত ২২টি মামলা হয়েছে।
রাজশাহীতে গ্রেপ্তার ১১ : কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজশাহীতে পুলিশের গাড়িতে হামলার অভিযোগে বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে। বুধবার রাতে নগরীর রাজপাড়া থানায় ১৪ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন এসআই আবু শাহাদাত। মামলার পর ১১ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। হামলায় দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন- নগরীর উপশহর এলাকার উয়াকিউর রহমান শাওন (২০), মইন প্রত্যয় (২৩), দড়িখরবোনা এলাকার তানভীর আঞ্জুম রাকিম (২০), রামচন্দ্রপুর এলাকার তাসনিম আলম (২১), মোল্লাপাড়া এলাকার মুরাদ হোসেন (২১), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পশ্চিমপাড়ার আবদুল মোহাইমিন (১৮), চারঘাট থানার মুংলী গ্রামের মাহফুজুর রহমান (২২), তানোর উপজেলার দেবীপুর গ্রামের আবদুল হালিম (২২), পুঠিয়া উপজেলার বালিয়াঘাটা গ্রামের আসিফ হাসান (২২), দুর্গাপুর উপজেলার কিসমতমারিয়া গ্রামের সোহানুর রহমান (২৭) ও গাইবান্ধার রিফাত সরকার (২০)।
শাবি ফটক থেকে দুই যুবক আটক : শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে থেকে দুই যুবককে আটক করেছে পুলিশ। তবে ওই দুই যুবক শিক্ষার্থী নয়, বহিরাগত বলে দাবি করেছে পুলিশ। গতকাল বিকাল ৩টার দিকে তাদের আটক করা হয়। আটককৃতদের নাম ও পরিচয় জানা যায়নি। এদিকে বুধবার রাতে তিন ছাত্রকে আটক করে পুলিশ থানায় নিয়ে এলে গতকাল শিক্ষকরা গিয়ে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন।
জানা গেছে, কোটা ইস্যুতে নিহতদের স্মরণে ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালনের লক্ষ্যে গতকাল বেলা ২টার দিকে শাবির প্রধান ফটকে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। বিকাল ৩টার দিকে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। এ সময় দুজনকে আটক করা হয়।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ জানান, আটক দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নয়। তারা বহিরাগত।
চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক গ্রেপ্তার : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের দারুল উলুম মাদরাসার সমন্বয়ক আদনান শরীফ নামে এক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার রাতে নগরীর চকবাজার থানার ডিসি কফিল উদ্দীন জামে মসজিদ পাশের একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল পাঁচলাইশ থানার কোটা সংস্কার আন্দোলনের হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক সুমাইয়া শিকদার। তিনি বলেন, আদনান শরীফ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি চট্টগ্রামের দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসার সমন্বয়কের দায়িত্বে আছেন।
পাঁচলাইশ থানার এসআই ইমাম হোসেন জানান, গত ১৬ জুলাই নগরীর মুরাদপুরে সংঘর্ষের ঘটনায় আদনান শরীফ জড়িত। ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজে আদনান শরীফকে দেখা গেছে। এজন্য তাকে পাঁচলাইশ থানার হত্যা ও বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আদনান শরীফের বাবা নুরুল হক জানান, রাতে পুলিশ এসে বাসা থেকে ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। আমার ছেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। পরিবারের সঙ্গে বাসায় ছিল। বুধবার দিবাগত রাতে পুলিশ কেন নিয়ে গেল বুঝতে পারছি না।