আন্দোলনরত বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী গুলি (লাইভ রাউন্ড) না চালাতে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে করা রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাই কোর্ট। গতকাল বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদেশে সাত দফা পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আদালত।
পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছেন, কেউ আইন লঙ্ঘন করলে পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও তারপরে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করতে পারবে। যদি কোনো লঙ্ঘন না ঘটে বা কোনো দাঙ্গা না হয়, তবে কোনো প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করা যাবে না।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন শুনানি করেন। সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনির, শেখ মোহাম্মদ মোর্শেদ ও মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী। রিটকারীদের পক্ষে এদিন ব্যারিস্টার সারা হোসেন ও অনীক আর হক শুনানি করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক ও আজাহার উল্লাহ ভূইয়ার বক্তব্য শোনেন আদালত। পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ ও জনসভা করার অধিকার রয়েছে। মানুষের জীবন সবচেয়ে দামি সম্পদ। মানুষের জীবন ও মর্যাদা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেখানে কঠিনভাবে প্রয়োজন কেবল সেখানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগ করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করতে হবে এবং সবার মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কোনো প্রকার বৈষম্য করতে পারবে না। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইনের বাধ্যবাধকতা মানতে হবে এবং ব্যর্থতার জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বেআইনিতে (সহিংস, দাঙ্গা) পরিণত হলে পুলিশ সংশ্লিষ্ট আইন ও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ব্যবহার শুরু করবে। এ অবস্থায় পুলিশকে সংবিধানের ৩২, ৩৩ (আই) (এম), ৩৬, ৩৭ ও ৩৮, ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৭-১৩২, পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি) এর ১৫৩, ১৫৪, ১৫৫, ১৫৬, ১৫৭ ও দন্ডবিধির ৯৬-১০৬ পর্যন্ত অনুসরণ করতে হবে। হাই কোর্ট বলেন, তবে কেউ যদি আইন অমান্য করে তখন পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাবার বুলেট, টিয়ার শেল, ব্যবহার করতে পারে এবং পরে গ্রাণঘাতী গুলি। কিন্তু যদি কোনো অমান্য না হয় বা কোনো দাঙ্গা না হয় তাহলে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করতে পারবে না।
উচ্চ আদালত আরও বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে এটা প্রয়োজনীয় যে, পুলিশ আইনের চারটি কর্নার (সংবিধান, পিআরবি, সিআরপিসি ও দন্ডবিধি) অনুসারে দায়িত্ব পালন করবে এবং সংবিধানে জনগণের দেওয়া অধিকার অনুসারে। আর আবেদনের দ্বিতীয় অংশ (ছয় সমন্বয়কের মুক্তি) এখন অকার্যকর হয়েছে। তাই বিষয়টি আমলে নেওয়া হচ্ছে না। আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, রিট করার একটা রুলস আছে। সেই রুলস ব্যত্যয়ের কারণে আমরা রিটটি খারিজ চেয়েছি। আদালত আমাদের বক্তব্য শুনে পিটিশনটি সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন। তবে আদালত কয়েকটি অবজারভেশন দিয়েছেন। তিনি বলেন, খুলনায় একজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে মেরেছে সেটা সম্পর্কে আবেদনে (রিট আবেদনে) কিছু ছিল না। একজন পুলিশকে যাত্রাবাড়ীতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছে। একজন নাগরিককে উত্তরায় মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেটা সম্পর্কে তাদের (রিটকারীদের) কোনো বক্তব্য ছিল না। আমরা বলছি যে কথা বললে সবার জন্য বলতে হবে। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওনাদের (আবেদনকারীদের) রাজনৈতিক বিবৃতি দেখেছি। ওনাদের উদ্দেশ্য এক দফার আন্দোলন। আরেকজন বলছে তুমি কবে বাংলা ছাড়বা। ওনারা পলিটিক্যাল উদ্দেশে এসেছে। এর আগে ২৯ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী এ রিট করেন। তারা হলেন আইনজীবী মনজুর-আল-মতিন ও আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। রিটে আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। ২৯ জুলাই ও ৩০ জুলাই এ রিটের ওপর শুনানি হয়। গত ৩১ জুলাই রিটটি আদেশের জন্য বেঞ্চটির কার্যতালিকায় ওঠে। তবে বেঞ্চের একজন বিচারপতি অসুস্থতার কারণে ছুটিতে থাকায় সেদিন দ্বৈত বেঞ্চ বসেনি। একই কারণে গত বৃহস্পতিবার দ্বৈত বেঞ্চ বসেনি। তাই শুনানি হয়নি। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়।