আমি আমার মায়ের কাছ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর বিদায় নিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি মরে গেলে কেঁদো না। আর বেঁচে থাকলে বিকালে ফোন দেব। এই ভয়েস রেকর্ডটা শুনিয়ে শুনিয়ে মারত। ওরা আমাকে ১৫ জুলাই থেকে মোবাইলে ট্র্যাক করছিল। এমনটা বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হাতে আটক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রধান সমন্বয়ক নূর নবী। শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে সাংবাদিকদের কাছে এ নির্যাতনের বর্ণনা দেন তিনি। এর আগে গত ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান এ সমন্বয়ক।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জবির অন্যতম এই সমন্বয়ক বলেন, ‘আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিবিরি অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) বদরুল আমাকে ডেকে আলাদা করেন। ডিবির পাঁচটি গাড়ি এসেছিল। তারা শুধু আমাকে উঠিয়ে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠিয়েই মার শুরু করে। যখন আমাকে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়, তখন ভেবেছিলাম গাড়িতে যে টর্চার করা হয়েছে এর চেয়ে বেশি টর্চার আর হতে পারে না। কিন্তু এর চেয়ে পাশবিক নির্যাতন যে তারা করতে পারে তা আমার কল্পনায় ছিল না।’
সমন্বয়ক নূর নবী বলেন, ডিবিতে নেওয়ার পর আমাকে প্রস্রাব করতে বলে। প্রস্রাব করতেই বৈদ্যুতিক শক খেয়েছি আমি। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে গেছি। হাতে একটা ইনজেকশন দিয়েছে আমার। ওরা আমার অ-কোষে জোরে জোরে আঘাত করেছে। মনে হচ্ছিল, আমি মরে যাচ্ছি না কেন। তাঁরা বারবার আমার কাছে সমন্বয়কদের নাম জানতে চাচ্ছিল। আমার কাছ থেকে বিএনসিসির কার্ড পায়। পরে নিজেদের মধ্যে বলে, ‘সে এত শক্ত কেন? এ জঙ্গি, জঙ্গি ট্রেনিং নিয়েছে।’ আমি এটা বলতে পারিনি যে, ‘আমি সেনা মহড়ায় অংশ নিয়েছি, আমি অন্তত জঙ্গি হতে পারি না।’
নূর নবী আরও বলেন, ডিবি কার্যালয়ে একপর্যায়ে একটি চেয়ারে বসিয়ে আমার সব কাপড়চোপড় খুলে ফেলে। সেই চেয়ারে বসিয়ে গালি দিচ্ছিল। তখন পাশের অন্যদের কথা শুনে বুঝতে পারি যে, ডিসি আসছে। তখন আমাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে নিচে শোয়ায়। চিৎকরে শুইয়ে আমাকে বলে, ‘তোর এক হাত তো ছাত্রলীগ ভেঙেছে, আরেক হাত আমরা ভেঙে দেব।’ রুটি যেভাবে বেলে, ঠিক সেভাবে আমার হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত লাঠি দিয়ে চাপ দেয়। আমাকে কান্না করতে পর্যন্ত দেয়নি। আমি ভাবছিলাম যে, এরা মানুষ না। মেরে মেরে আমাকে বারবার বলছিল, ‘তোর তথ্য অনেক দিন শুনেছি, ক্যাম্পাস থেকে কয়েকজন তোর কথা আগেই বলেছে। তুই জঙ্গি, তুই শিবির।’ ভেবেছিলাম আমার পায়ের অংশ পচে যাবে বা কেটে ফেলতে হবে!
নূর নবী বলেন, ‘আমার হাত ভেঙে গেছিল। হাড় ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল। কোনোরকম এক্সরে ছাড়াই খুব বাজেভাবে অপারেশন করা হয়েছিল। বিকাল সাড়ে ৪টায় ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশিদ আসেন। এসে বলেন, ‘একে বাঁচিয়ে রাখছ কেন? ক্রসফায়ার দে।’ এরপর ডিবির লালবাগ শাখা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। আমার দুই হাঁটু পিটিয়ে ওরা ভেঙে ফেলে। ওই হাঁটুর ওপর তারা আমাকে বসায়ে রাখে। আমি ভাবছি আমাকে মেরেই ফেলবে। তারা আমার মাথায় বন্দুক তাক করে বলে, ‘একে মেরেই ফেলব। বাংলাদেশের যত সমস্যার মূল এই ছাত্ররা। এরা শিবির, এরা সাধারণ ছাত্রদের উসকে দিয়েছে।’ আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আমাকে মেরেই ফেলবে।
কারাগারে নির্মম অত্যাচারের কথা বর্ণনা করে নূর নবী বলেন, ‘কারাগারে আমি অনেক রক্ষীকে কান্না করে বলেছি, আমাকে হাসপাতালে নেন। নেয়নি। আমি এক প্যান্টে আট দিন পরে ছিলাম। আমাকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। আমাকে আমদানিতে (কারাগারের আমদানি কক্ষ) পাঠায় দিছে। আমি একদিক হয়েও শুয়ে থাকতে পারতাম না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার, পারি নাই। শেষে ২৭ তারিখে আমাকে মেডিকেলে নেওয়া হয়। ডাক্তার দেখে বলে ওকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে নিতে হবে। ঢাকা মেডিকেল বা পঙ্গুতে রেফার করে। তবুও হাসপাতালে নেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারাগারে যখন অন্য ছাত্ররা জানতে পারে, আমি সমন্বয়ক। তখন তারা দেখা করতে আসে। আমি একটু সাহস পাই। পানিতে মরিচ দিয়ে রাখা হতো, যেন পানি খেতে না পারি, গোসল করতে না পারি। স্যারেরা যখন দেখা করতে আসে, তখন আমাকে একপর্যায়ে বলা হয়, টাওয়ারে আলাদা এক ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তখন আমি সবাইকে আমার কাছে আসতে বারণ করি। আমি নিজেকে একঘরে করে রাখি।’
সাজানো মামলা দেওয়ার ঘটনা বর্ণনায় নূর নবী বলেন, ‘তারা আমাকে বলে, ‘তোকে ক্রসফায়ার দেব। তুই রেডি হয়ে নে।’ আমরা ছয়জন ছিলাম মোট। রমনায় নিয়ে চোখ খুলে দেওয়া হলো। আমার হাতে পেট্রলবোমা ধরিয়ে দেয়। ভিডিও করা শুরু করল। তারা যে মামলা সাজাবে আমি ভাবতেও পারিনি। ডিবি এমন পর্যায়ে যাবে ভাবিনি। ডিবি দেশের মানুষের আস্থার জায়গা হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক তারা আমাকে মেরে ফেলেনি। আমি বেঁচে ফিরেছি। স্বাধীন দেশে ফিরতে পেরেছি। এটা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা।