সবুজ ধানখেতের পাশে কাঠা দশেক জায়গা হালচাষ করা। জমিতে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিদ্যুতের খুঁটি। সেই খুঁটির সঙ্গে ঝুলছে টাঙানো তার। জমির এক কোণে শুধু একটা আমগাছ। দেখে মনে হচ্ছে, হালচাষের পর এ জমি পতিত ফেলে রাখা হয়েছে। ১০ দিন আগে এখানেই ছিল দুলাল ঘোষ আর তার জামাতা কমল ঘোষের বাড়ি। এখন হিন্দু সম্প্রদায়ের এ বাড়ি দুটির চিহ্নমাত্র নেই। দুলাল ঘোষ তার ভিটায় এসে জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি দেখিয়ে বলেন, ‘কারেন্টের তারগুলো শুধু আছে। মিটারটাও খুলে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া বাড়ির পাশের প্রায় দেড় বিঘা জমিতে ধান ছিল। সেগুলোও দখলে নিয়েছে হামলাকারীরা। এখন আমার থাকার জায়গা নেই। ছেলের বাড়িতে আছি। মেয়ে থাকে আরেক মেয়ের বাড়িতে। হামলাকারীরা হুমকি দিয়েছে, ভিটায় এলে লাশ ফেলে দেওয়া হবে।’ কান্নায় ভেঙে পড়ে দুলাল এ ঘটনার বিচার চান।
এ ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের হিজলগাছি গ্রামে। হামলা, লুটপাট ও উচ্ছেদের পর শিবা রানী ও দুলাল ঘোষ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হায়াতের কাছে এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। ইউএনও সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলেন। সেনা সদস্যরা রিপন নামের এক হামলাকারীকে আটকও করেছিল। পরে একই জমিতে তাদের বাড়ি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে রিপনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পরে বাড়ি তো করে দেওয়া হয়নি, উল্টো এখন ভিটা ছেড়ে দিতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন তারা। ইউএনও জানালেন, দুলাল ও কমলের বসতবাড়ি কেউ দখলে নিতে পারবে না। ঊাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার পর শিবা রানী তার বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার স্বামী কমল ঘোষ গরুর দুধ সংগ্রহের কাজ করতেন। শিবা রানীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘হামলার সময় বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ ছিল না। হামলাকারীরা আমার ১৫ বছরের মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল। মেয়ের ইজ্জত রক্ষায় আমি তাকে নিয়ে এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছি। বাড়ির আর কিছুই পাইনি।’ জানা যায়, প্রায় ৩০ বছর আগে পৌনে দুই বিঘা খাসজমি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ১০০ বছরের জন্য পত্তন নেন দুলালের দাদা। জমি পত্তন নেওয়ার পর কিছু লোক ওই জমি নিজেদের বলে দাবি করেন। তখন গ্রামে সালিশ বসে। সালিশে কাগজপত্র দেখে জমি দুলালদেরই দেওয়া হয়। প্রায় ১০ বছর আগে দুলাল জমির একটি অংশে বাড়ি করেন। বাকি অংশে ফসলের আবাদ করা হয়। কয়েক বছর আগে জামাতা কমল ঘোষকেও বাড়ি করতে দেন। এতদিন আর কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি। হঠাৎ গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর স্থানীয় ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির ১৫-২০ জন নেতা-কর্মী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় দুই বাড়ি থেকে স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা, ঢেউটিন, ফ্রিজ ও টেলিভিশনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র লুট করে নেওয়া হয়। ইউএনওকে দেওয়া লিখিত অভিযোগে হামলাকারী হিসেবে জয়দুল ইসলাম ফেন্সু, তার দুই ছেলে নবাব ও জনি; ভাই শরিফুল ইসলাম ও লালমিয়া; ভগ্নিপতি আসারুল ও সেলিম; বিএনপিকর্মী পলাশ, সুইট, সালাম, জাকিরুল ও রিপনসহ অজ্ঞাত ১৫-২০ জনের কথা উল্লেখ রয়েছে। গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হায়াত বলেন, ঘটনাটি তিনি জানেন। অভিযোগ পেয়ে তিনিই সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাঠিয়েছিলেন। এখনো সমস্যার সমাধান না হলে তিনি নিজে যাবেন। দুলাল ও কমলের বসতবাড়ি কেউ দখলে নিতে পারবে না। এ ব্যাপারে তিনি প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।