বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ২০ দিনে (১৮ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট) ১২ জন বিভিন্ন বয়সী নারী, কন্যাশিশু ও কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বয়স্ক নারী যেমন আছেন তেমন আছে ছয় বছরের ফুটফুটে শিশুও। নিহতের মধ্যে আছেন চারজন শিক্ষার্থী, গৃহবধূ ও গৃহকর্মী। এদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন আর দুজনের মৃত্যু হয় আগুনে পুড়ে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ১৫ বছরের নাঈমা সুলতানা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এদিন বিকালে রাজধানীর উত্তরার বাসার বারান্দায় শুকাতে দেওয়া কাপড় আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় নাঈমার।
আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের আরেকজন নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭)। টঙ্গীর এরশাদনগর বস্তি এলাকার ৮ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা আবুল হোসেনের বড় মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাফিসা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নাফিসা টঙ্গীর শাহাজ উদ্দিন সরকার স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রথমে নাফিসা রাজধানীর উত্তরায় আন্দোলনে যোগ দেন। তার বাবা বিষয়টি জানতে পেরে নাফিসাকে নিষেধ করেন। ১ আগস্ট নাফিসা চলে যান ঢাকার সাভারের বক্তারপুরে মামার বাড়ি। সেখান থেকে ফের যোগ দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। এরপর ৫ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন নাফিসা। অন্য শিক্ষার্থীরা আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর পেয়ে তার বাবা হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে আসেন টঙ্গীর এরশাদনগরে।
ছোট্ট শিশু রিয়া গোপ (৬) ১৯ জুলাই ছাদে খেলতে গিয়েছিল। রাস্তায় সংঘর্ষ শুরু হলে বাবা দীপক কুমার গোপ মেয়েকে বাসায় আনতে ছাদে যান। রিয়াকে কোলে তুলে নিতেই একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তার মাথায়। এরপর পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে শিশুটির মৃত্যু হয়। রিয়া ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। শিশুটি এ বছর স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। এ ছাড়া ৪ আগস্ট শেরপুর কলেজের সামনে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মিম আক্তার (১৯) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।
নাছিমা আক্তার (২৪) তার দুই ভাতিজাকে নিয়ে ১৯ জুলাই ছাদে গিয়েছিলেন। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে পরদিন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নাছিমার ভাবি রেহানা জানান, গুলি তার ছেলের বুকের এক পাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে পেছনে থাকা নাছিমার গালের ভেতর দিয়ে গলার খাদ্যনালিতে ঢুকে যায়। রেহেনা তার তিন ছেলে ও ননদকে নিয়ে ধানমন্ডি ১ নম্বরে একটি ভবনে ভাড়া থাকতেন। গৃহকর্মী লিজা আক্তার (১৯) রাজধানীর শান্তিনগরে একটি বাসায় কাজ করতেন। ১৮ জুলাই দুপুরে বাসাটির বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই তার পেটে গুলি লাগে। লিজা যে পরিবারটির সঙ্গে থাকতেন তারা প্রথমে লিজাকে অরোরা স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ২২ জুলাই হাসপাতালে লিজা মারা যান। ২০ জুলাই সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে সুমাইয়া আক্তার (২০) নামে এক গৃহিণী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আড়াই মাস বয়সি শিশু সন্তানের মা সুমাইয়া পরিবারের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদিতে বাস করতেন। ঘটনার দিন সুমাইয়া তার মায়ের সঙ্গে বাসভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
রাজধানীর বনশ্রীতে রামপুরা থানার সামনে মেরাদিয়া হাট এলাকায় স্বামী, ছেলে, ছেলেবউ এবং নাতি নিয়ে থাকতেন মায়া ইসলাম (৬০)। ১৯ জুলাই বাইরে বিক্ষোভ পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে দুপুরে নাতিকে নিয়ে বাসার নিচে নামেন। এ সময় গুলি এসে মায়ার নাতির মাথার এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে তার তলপেটে ঢোকে। গুলিবিদ্ধ মায়াকে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে তারা এক স্বজনের বাসায় যান। পরদিন ২০ জুলাই সকালে মায়া ইসলামের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ছাড়া হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির দেওয়া তথ্যমতে, ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় নাছিমা আক্তার (২৪) নামে আরেক নারীর মৃত্যু হয়। কিশোরগঞ্জে ৪ আগস্ট আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু হয়। এতে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসার দারোয়ান আলম মিয়ার স্ত্রী অঞ্জনা বেগম (৩২) এবং তাদের সাত বছরের মেয়ে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সহিংসতায় আগুন লেগে অঞ্জনা ও তার মেয়ের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ৫ আগস্ট সাভারে সহিংসতায় সাজেদা আক্তার নামে (৪০) আরেক নারী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।