বন্যার্তদের সহায়তায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরিব, রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে আজ একতাবদ্ধ পুরো দেশ। সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি মানুষ স্ব স্ব অবস্থান থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসছেন। সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি সরাসরি মাঠে থেকে ত্রাণ সংগ্রহ, বিতরণ ও উদ্ধার অভিযানে রয়েছেন ছাত্র-জনতা। অভিজ্ঞতা না থাকলেও তীব্র স্রোতের মধ্যে জীবন বাজি রেখে বুক সমান পানি ঠেলে উদ্ধার করে আনছেন বন্যা দুর্গতদের। প্রতিটা এলাকায় দল বেঁধে গণত্রাণ সংগ্রহ করছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। তহবিল সংগ্রহ করছেন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল, সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও। লাইনে দাঁড়িয়ে সেসব জায়গায় সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা পৌঁছে দিচ্ছেন সবাই। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মীরা একদিনের বেতন দান করেছেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএলসহ বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো।
বাড়ির সামনে গলা সমান পানি। -বাংলাদেশ প্রতিদিন
কুমিল্লায় ছাগল কাঁধে নিয়ে উঁচু স্থানে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি -বাংলাদেশ প্রতিদিন
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে নৌকা-স্পিডবোট নিয়ে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষজনকে উদ্ধারে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী মানুষজন। দেশের এক প্রান্ত থেকে মানুষ ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন অন্য প্রান্তে। অনেকে কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, পিক-আপ ভরে নিয়ে যাচ্ছেন শুকনো খাবার, জরুরি ওষুধ, বিশুদ্ধ পানি, চাল-ডাল-তেল। রান্না করে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে বন্যার্তদের মাঝে। বানভাসিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে নগদ অর্থ, কাপড়, শুকনো খাবার, ওষুধ, পানি, সাবানসহ বিভিন্ন উপকরণ। অনেকে সহায়তা প্রদান করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে। বন্যার্তদের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে গত চার দিন ধরে গণমানুষের গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচিতে লাইন ধরে মানুষকে টাকাসহ বিভিন্ন উপকরণ প্রদান করতে দেখা গেছে। সেখানে শিশুদেরও দেখা গেছে প্লাস্টিকের ব্যাংকে জমানো টাকা নিয়ে হাজির হতে। এদিকে বন্যাকবলিত মানুষের জন্য দুর্যোগের শুরুতেই ফ্রি টকটাইম এবং ইন্টারনেট সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে দেশের মোবাইল অপারেটররা। যে যেভাবে পারছেন সেভাবেই দাঁড়াচ্ছেন বানভাসি মানুষের পাশে।
বন্যার্তদের উদ্ধার, চিকিৎসাসেবা ও ত্রাণ বিতরণে সশস্ত্র বাহিনী : বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সারা দেশে বন্যার্তদের উদ্ধার, চিকিৎসাসেবা ও ত্রাণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ২৩০০ জন বন্যাদুর্গত ব্যক্তিকে হেলিকপ্টার ও বোটযোগে উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি ১৮ হাজার ৩৯৪ প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। আইএসপিআর জানায়, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সমন্বয়ে ৭টি অস্থায়ী মেডিকেল টিমের মাধ্যমে ৮৬৪ জনকে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি ও র?্যাবের হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আকাশপথে ৪ হাজার ৪৮২ প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী দুর্গম এলাকায় পৌঁছানো হয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকায় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে বিমান বাহিনী : বন্যাদুর্গত এলাকা ফেনীর ছাগলনাইয়ায় গতকাল থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা মেডিকেল ক্যাম্পেইন পরিচালনা শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় রোগীদের বিমান বাহিনী কর্তৃক চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ প্রদান করা হচ্ছে। আইএসপিআর জানায়, বন্যাদুর্গত এলাকা ফেনী থেকে জরুরি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গর্ভবতী মহিলাসহ অন্যান্য মুমূর্ষু রোগীদের বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশারে আনা হয় এবং প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। পাশাপাশি বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম চলছে।
বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে ইমামদের আহ্বান : বানভাসি ও বন্যাকবলিত মানুষের পাশে সামর্থ্য অনুযায়ী দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন মসজিদের খতিবরা। প্রতিদিনই নামাজের সময় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা। এক্ষেত্রে অনেক মসজিদে কমিটির পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে ত্রাণ সহায়তা বিতরণের উদ্যোগ।
দুর্গোৎসবের বাজেট থেকে বন্যার্তদের সহায়তা : বন্যা ঘিরে সম্প্রীতির অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও। তাদের দুর্গোৎসব আয়োজনের বাজেট থেকে বন্যাদুর্গতদের অর্থ সহায়তা পাঠিয়েছে বরিশালের বেশ কয়েকটি মন্দির কমিটি। আরও কয়েকটি কমিটি সহায়তা পাঠাতে তহবিল প্রস্তুত করেছে বলে জানা গেছে।
অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, তারা ৫০০ টন ত্রাণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
এক দিনের বেতন দিচ্ছেন অনেকে : বানভাসিদের সহায়তায় এক দিনের বেতন তুলে দিচ্ছেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও পেশাজীবীরা। বন্যার্তদের সহায়তায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে ইতোমধ্যে কর্মীদের এক দিনের বেতন তুলে দিয়েছে বা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, র্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, দুর্নীতি দমন কমিশন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষকরা, তথ্য ও ডাক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা, জনতা ব্যাংকের কর্মীরা, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং মাঠ প্রশাসনের সব সদস্য, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষক-কর্মকর্তারা, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা, অর্থ মন্ত্রণালয় ও এর বিভিন্ন বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী।