নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা আপাতত ভাবছে না অন্তর্বর্তী সরকার। একযোগ প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি ও চারজন নির্বাচন কমিশনার গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করায় সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেইসঙ্গে আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন উপযোগী হতে যাওয়া ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন এবং স্থগিত থাকা অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তবে আপাতত নির্বাচন না হলেও জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। গতকাল স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন অনুযায়ী পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সিটি করপোরেশনগুলোর প্রশাসকদের সিটি করপোরেশন অধিক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সেবা বিশেষ করে জাতীয়তা ও চারিত্রিক সনদ, মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার সনদ ইত্যাদি দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা করেনি অন্তর্বর্তী সরকার। উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে একজন উপদেষ্টা এ বিষয়ে আলোচনা তুললেও তা খুব বেশি এগোয়নি। এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, নাকি ইসি নিয়োগের আইন সংস্কারের পরই কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে সেই বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এর আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বেশিরভাগ সিটি ও পৌর মেয়র-কাউন্সিলররা এবং জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান। এরপর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বিঘিœত হয়, ভোগান্তিতে পড়েন সেবা প্রার্থীরা। এই প্রেক্ষাপটে আইনগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। একটি ধারায় বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে, জনস্বার্থে কোনো মেয়র-কাউন্সিলর ও চেয়ারম্যান-ভাইস-চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান বা অন্য সদস্যদের অপসারণ করতে পারবে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশসহ অন্যান্য আইনের নতুন অন্তর্ভুক্ত ধারায় বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে, জনস্বার্থে কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত উপযুক্ত কর্মকর্তাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে। প্রয়োজনে যথাযথ বলে বিবেচিত হয় এমন সংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে গঠিত কমিটিকে প্রশাসকের কাজে সহায়তা দিতে নিয়োগ করতে পারবে।? নিযুক্ত প্রশাসক এবং নিযুক্ত কমিটির সদস্যরা স্থলাভিষিক্ত পদের ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করার পর প্রশাসক দিয়ে নাগরিক সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। একইভাবে স্থানীয় সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলাও চলছে প্রশাসকের মাধ্যমে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় সংসদের আগেই স্থানীয় নির্বাচন করা উচিত। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া উচিত।
ডিসেম্বরে নির্বাচনি ক্ষণগণনা শুরু হবে ঢাকার দুই সিটিতে : ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে ইভিএমে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে। আর আইন অনুযায়ী করপোরেশনের প্রথম বৈঠক থেকে এর মেয়াদ গণনা শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ২ জুন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ৩ জুন। সেই হিসাবে ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচনি ক্ষণগণনা শুরু হবে চলতি বছরের ৪ ডিসেম্বর থেকে। আর দক্ষিণ সিটির ক্ষণগণনা শুরু হবে ৫ ডিসেম্বর। দুই সিটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ১ ও ২ জুন। দিন গণনার শুরুর দিন থেকে যে কোনো দিন ভোট গ্রহণ করার আইন রয়েছে।
স্থগিত স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচন : গত ২১ জুলাই সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ সব নির্বাচন ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) হওয়ার কথা ছিল। ইসি ওই সময়ে বলেছে, সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় অনলাইনে ভোটার তালিকা আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া ভোটে ব্যবহারের জন্য ইভিএম কাস্টমাইজ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
ইসি নিয়োগ নিয়ে বিশ্লেষকরা : সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক বলেছেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেবেন। এটা রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। এখনো সরকার কোনো নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি। রোডম্যাপ ঘোষণা করলে, তখন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়টাও আসবে। নির্বাচন কমিশন শূন্য থাকা এবং নির্বাচনি আইন সংস্কারের বিষয়ে কোনো সমস্যা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসি শূন্য থাকলে কোনো সমস্যা নেই। এখন তো নির্বাচন নেই। যেহেতু সংস্কার করার সুযোগ এসেছে। তাই সব কিছু সংস্কার করে নেওয়াই ভালো। সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের ভোটাধিকার নিয়ে ভবিষ্যতে আর যেন ছিনিমিনি খেলা না হয়, সে লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনি আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ কাজে নেতৃত্ব প্রদর্শনে এবং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কয়েকজন সৎ, নির্ভীক ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের জন্য অনতিবিলম্বে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের জন্য ২০২২ সালে একটি আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে আইনে কমিশনার নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি এবং কমিশনারদের নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখার ব্যাপারে অস্পষ্টতা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন হাবিবুল আউয়াল। তার নেতৃত্বে এ কমিশনের পরিচালনায় এ বছর ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। এছাড়া এ আড়াই বছরে দেড় সহস্রাধিক বিভিন্ন নির্বাচন করেছে কমিশন। ৫ সেপ্টম্বর মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর বাকি থাকতেই সাংবিধানিক পদ থেকে পদত্যাগ করেন তারা।