দায়িত্ব গ্রহণের পর অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম এবং ব্যয়বহুল জ্বালানির বদলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এর মধ্যে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ। তবে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম বাধা জমি স্বল্পতা। এ কারণে জমি ব্যবস্থাপনার জন্য এ সরকার এবার ভাসমান সোলার সিস্টেমের সম্ভাবনা যাচাইয়ের পাশাপাশি চা বাগানে সোলার সিস্টেম করা যায় কি না তা খতিয়ে দেখছে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকার চরাঞ্চলের জমি আশার আলো হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে এলাকায় সূর্যের রেডিয়েশন বেশি সেখানে সৌরবিদ্যুৎ জোন করে দিলে জমির ব্যবস্থাপনায় যে সমস্যা আছে তার অনেকটাই সমাধান মিলবে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৩০টি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। যার সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৭৪৩ মেগাওয়াট। এ প্রকল্পগুলো এখন বাস্তবায়নের নানা পর্যায়ে আছে। এর বাইরে নতুন করে ৫৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে হাজার হাজার একর জমির প্রয়োজন। আর এসব কেন্দ্রের জন্য যে জমি সংগ্রহ করা হচ্ছে তার বড় অংশই আবাদযোগ্য কৃষিজমি। অথচ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কৃষিজমি ব্যবহারের বিষয়টি প্রথম থেকেই নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। যদিও সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া ৩১টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিতর্কিত বিশেষ আইনে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকল্পগুলো নেওয়ার কারণে এ সরকার এগুলো বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমরা এরই মধ্যে বেশ কিছু জমি চিহ্নিত করেছি। আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানসহ বাইরের কিছু সংস্থা এ কাজ করেছে। আমরা এগুলো নিয়েই এগিয়ে যাব। এখন আমরা সৌর বিদ্যুতে খুব গুরুত্ব দিচ্ছি কারণ আমরা আমদানিকৃত জ্বালানির বিল দিতে পারছি না। এ জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলে যাব। সৌর বিদ্যুতের দিকে আমরা খুব জোরেশোরে এগিয়ে যাব। কিছুদিনের মধ্যে আমরা এজন্য উন্মুক্ত টেন্ডারের আমন্ত্রণ জানাব। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার জমির স্বল্পতার জন্য ভাসমান সোলার সিস্টেমের দিকে এগোনো যায় কি না এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এজন্য নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তি খুঁজে বের করে টেকসই সোলার সেল গঠন করার কথা ভাবা হচ্ছে। এমনকি চা বাগানে সোলার সিস্টেম করা যায় কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জ্বালানি খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের এক গবেষণা বলছে, এক মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনে ৩ একর জমির প্রয়োজন। বাংলাদেশের জমি অত্যন্ত মূল্যবান এবং উর্বর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আবাদযোগ্য জমি সোলার প্যানেল দিয়ে ছেয়ে ফেলা ঠিক নয়। যদিও এর মধ্যে কয়েকটি সোলার পার্কে প্যানেলের নিচে ফসল উৎপাদন করে ভালো ফলাফলও এসেছে। সৌরবিদ্যুতের সুফল পেতে বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনার ছাদকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তারা। এ ছাড়া জমির সংকট কাটাতে বিভিন্ন নৌবন্দর, বিমানবন্দর, ক্যান্টনমেন্টে খালি পড়ে থাকা অব্যবহৃত জমি কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন।
আশা জাগাচ্ছে চরাঞ্চল : সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পকে কৃষিবান্ধব করতে এরই মধ্যে উদ্যোক্তারা অনাবাদি জমি ও চরে সোলার প্যানেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছেন। সোলার প্যানেলের নিচে মাছ ও শাকসবজি চাষ করা হচ্ছে। কিছুক্ষেত্রে সোলার প্যানেলগুলোর চারপাশে ফলের বাগান করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ৭ দশমিক ৬ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্টের নিচে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষে সফলতা এসেছে। সেখানকার সোলার প্যানেলের নিচে তরমুজ, কচু, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন ফল ও সবজির চাষ হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়ন সচিব মো. হাবিবুর রহমান এই প্রকল্প পরিদর্শন করে অন্য সোলার পাওয়ার প্ল্যান্টেও এটি বাস্তবায়ন করা যায় কি না দেখতে বলেছেন। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চর কাবিলপুরে ‘ফ্রেন্ডশিপ-সামিট সোলার ভিলেজ ৫৭ দশমিক ৬ কিলোওয়াট পিক ক্ষমতার’ একটি সোলার পার্ক তৈরি করা হয়েছে। সরেজমিন এই প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ২০০টি সোলার প্যানেল স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এ থেকে চরের ২০০-এর বেশি পরিবার এখন বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন। সেখানে সোলার প্যানেলের নিচের জমিতে শাক-সবজির চাষ হচ্ছে। বেগুন, লাল শাক, পুঁই শাক, ঢ্যাঁড়শ, পেঁপে এবং আমসহ বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলের চাষ করছে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সোলার প্যানেলের দায়িত্বে থাকা লোকেরা চরবাসীর বিদ্যুতের চাহিদা মিটিয়ে সেখানে উৎপাদিত বাড়তি শাকসবজি আশপাশের গ্রামবাসীদেরও দিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞ মতামত : একাধিক বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সৌর বিদ্যুতের জন্য জায়গা কোনো সমস্যা নয়। বাংলাদেশে যে অকৃষি খাসজমি আছে তার মাত্র পাঁচ শতাংশ ব্যবহার করেই ২৬ থেকে ২৭ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এরই মধ্যে বাস্তবায়নাধীন সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে দেখা গিয়েছে, সৌর বিদ্যুৎ যে জমিতে উৎপাদন করা হচ্ছে তার নিচে একই সঙ্গে ফসলও উৎপাদন হচ্ছে। মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছিল সেগুলোতে কমিশন বাণিজ্য ও দুর্নীতি অব্যাহত রাখতেই দেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জমি নেই এমন অজুহাত তৈরি করেছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিনির্ধারকরা। একই সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে যেহেতু বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টিও জড়িত এজন্য সেসময় আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সেই নবায়নযোগ্য প্রকল্পগুলোকেই অনুমোদন দিয়েছে যারা দুর্নীতি করার জন্য টাকা বা ঘুষ দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সোলার কমিশন তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জমির ব্যবস্থা করে।
তারা এজন্য জোনিংও করে দেয়। একইভাবে বাংলাদেশের যে এলাকায় সৌর বিদ্যুতের রেডিয়েশন বেশি যেমন- চট্টগ্রাম বিভাগ, সেখানে সৌরবিদ্যুতের জোনিং করে দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় খাস জমিগুলো উদ্ধার করে এই জমিগুলো জোন করে দিতে পারে। এ ছাড়া সরকার সেখানে সাব স্টেশন করে দিতে পারে। এতে খরচ কমে যাবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীও স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ দিতে পারবে। এক্ষেত্রে জমির যে সমস্যা তা সমাধান করা সম্ভব। জ্বালানি খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. জাকির হোসেন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের চর এলাকাগুলোকে অবশ্যই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগানো যেতে পারে। সোলার প্যানেলগুলো এখন ১৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে করা সম্ভব। আগে পুরো জমির ওপর সোলার প্যানেল স্থাপন করতে হতো, এখন জমির আইলের পাশ দিয়ে সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব। চরে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যদি কমিউনিটি গ্রিডে নেওয়া হয় এটি অনেকটা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মতো কাজ করবে। তখন তারা নিজেদের বিদ্যুৎ নিজেরাই উৎপাদন করবে এবং অতিরিক্ত বিদ্যুৎ থাকলে তা স্থানীয় উদ্যোক্তা ও বাণিজ্যিক কাজে কেউ নিতে চাইলে সরবরাহ করতে পারবেন।