ভয়ংকর মাদক সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন ২৯২ জন। বিভিন্ন সংস্থার তালিকায় তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে ‘গডফাদার’ হিসেবে। তালিকায় থাকা এসব ব্যক্তির অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও সিআইপি খেতাব পাওয়া ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। আইনপ্রণেতাও ছিলেন তাদের কয়েকজন। এসব গডফাদার, পাইকারি ব্যবসায়ী ও বহনকারী-এ তিন ক্যাটাগরিতে মোট ১০ হাজার জনের তালিকা নিয়ে মাঠে নেমেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
গডফাদার কিংবা পৃষ্ঠপোষকের কয়েকজন এরই মধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘোষণা দিয়ে অভিযান শুরু করার কারণে অনেক শীর্ষ ব্যবসায়ী এবং মদতদাতা
আত্মগোপনে চলে গেছেন। ৪ সেপ্টেম্বর অস্ত্র ও মাদকের বিষয়ে যৌথ অভিযানের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই এমনটা হচ্ছে। এতে কমে গেছে চালানের সংখ্যা, সঙ্গে পরিমাণও। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, শুধু বাহক নয়, মাদকের সঙ্গে জড়িত বড় বড় গডফাদারদের ধরতে হবে। চলমান যৌথ অভিযানে এ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে এবং দৈনিক অগ্রগতির রিপোর্ট প্রদান করতে হবে। মঙ্গলবার ডিএনসির সদর দপ্তরে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন তিনি। জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ডিএনসি ১৪১ গডফাদারের একটি তালিকা তৈরি করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠায়। দুদক চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো এ তালিকায় উল্লেখ করা হয়, অন্তত এদের অবৈধ আয়ের পথ ও বিশাল অর্থবিত্তের খোঁজ পেতে সক্ষম হবে দুদক। তখন তালিকায় থাকা অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা বেরিয়ে আসে। তবে রহস্যজনক কারণে তাদের প্রায় সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। ডিএনসির এবারের তালিকায় আগের সেই ১৪১ জনের বেশির ভাগই রয়েছেন। যারা মারা গেছেন, কেবল তাদের নামই বাদ গেছে। তবে ওই তালিকার সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু ব্যক্তির নাম যুক্ত হয়েছে। তালিকার শুরুর দিকেই রয়েছে সবচেয়ে ভয়ংকর গডফাদার কক্সবাজার-টেকনাফের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির নাম। ২০ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ২ সেপ্টেম্বর সিলেট থেকে র্যাব গ্রেপ্তার করে বদির ক্যাশিয়ার সালাহ উদ্দিনকে। র্যাব জানায়, ওমরাহযাত্রীর ছদ্মবেশে দেশ থেকে পালাচ্ছিলেন সালাহ উদ্দিন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সিলেটের এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়েতে থাকা একটি বিমান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৯-এর একটি দল। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল ইফতেখার আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘অস্ত্র ও মাদক নিয়ন্ত্রণ র্যাবের অন্যতম প্রধান কাজ। মাদকের সঙ্গে জড়িত যে-ই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর র্যাব। এজন্য আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।’
ডিএনসির পরিচালক (গোয়েন্দা-অপারেশন্স), উপমহাপরিদর্শক তানভীর মমতাজ বলেন, ‘তিন ক্যাটাগরিতে আমরা তালিকা তৈরি করেছি। ৩০০ জনের কিছু কম রয়েছেন গডফাদারের তালিকায়। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের অনেক সফল অভিযান হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বদি ২০০২ সালে প্রথমবার টেকনাফ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নৌকার হয়ে প্রথমবার সংসদে যান। এর পরই মাদকের জগতে কিং হয়ে উঠতে শুরু করেন তিনি। এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন মাদকসহ মিয়ানমারের সব চোরাচালান। মাদকের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের আন্তর্জাতিক চক্রের অন্যতম সদস্য বদি, যিনি ইয়াবা ও আইসের বাংলাদেশের রুট নিয়ন্ত্রণ করেন। মূলত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছত্রছায়ায় বদি মাদকের অপ্রতিরোধ্য গডফাদার হয়ে ওঠেন। তালিকায় বদির সঙ্গে তার পাঁচ ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমান, আবদুস শুক্কুর, মো. সফিক, আবদুল আমিন ও মো. ফয়সালের নামও রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বদির পিএস মং মং সেন ও ভাগনে সাহেদুর রহমান নিপুর নাম।
ডিএনসির তালিকায় থাকাদের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সাইফুল করিম নামে এক ব্যবসায়ী নিজেকে আমদানি-রপ্তানিকারক বলে পরিচয় দিলেও মাদক ব্যবসায় রয়েছে তার বড় বিনিয়োগ। ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থান করে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিভাগের তালিকায় রয়েছে কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, উখিয়ার সাবেক এমপি, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে অন্তত ২০ জন।
ফেনীর ইসমাইল হোসেনের নাম রয়েছে গডফাদারের তালিকায়। তার এক আত্মীয় বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকায় মাদক গডফাদারদের মধ্যে আছেন মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পের কলিম জাম্বো, চুয়া সেলিম, হিরণ, বুন্দিয়া সোহেল, ইশতিয়াক। এদের মূল পৃষ্ঠপোষক আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাষ্ট্রন। এ ছাড়া রামপুরা থানা যুবলীগ নেতা তানিম ও মেরুল-বাড্ডার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জয়নালসহ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর মিলিয়ে তালিকায় নাম রয়েছে ৯০ জনের।
মাদক নিয়ে কাজ করেন এমন অনেক অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, আসলে মাদক নিয়ন্ত্রণের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এবং সদস্যদের কমিটমেন্ট না থাকলে কখনো মাদক নিয়ন্ত্রণে আসবে না। সীমান্তরক্ষী বাহিনী এ দায় এড়াতে পারে না। কী পদক্ষেপ নিলে দেশে মাদক ঢুকবে না, তা গ্রহণ করা হোক। একই সঙ্গে ডিএনসির সদস্যদের অস্ত্র দেওয়া হোক। কারণ মাদক ব্যবসায়ীরা সব সময়ই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ও হিউম্যান রাইটস্ সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বলেন, ‘কোনো মাদক এ দেশে তৈরি হয় না। সীমান্ত পার হয়েই এগুলো দেশে ঢুকছে। তাই প্রবেশের জায়গাটায় আটকে দিতে পারলেই হয়ে যায়। এজন্য আন্তরিকতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির জায়গা থেকে ছিদ্রগুলো বন্ধ করা দরকার। একই সঙ্গে প্রয়োজন নিরপেক্ষ মনিটরিং।’ ডিএনসিসূত্র বলছেন, ভারতের ৩৬টি ফেনসিডিল কারখানার বেশির ভাগ অর্থাৎ ২৬টি রয়েছে রাজশাহী বিভাগের সীমান্তবর্তী এলাকার আশপাশে। তালিকায় রাজশাহী বিভাগের মোট ২১ জন হেরোইন গডফাদারসহ ৩৫ জনের নাম রয়েছে। গডফাদার, পাইকারি ব্যবসায়ী ও বহনকারী মিলিয়ে ১ হাজার ৩৯২ জনের তালিকা রয়েছে এ বিভাগে। খুলনা বিভাগে গডফাদারের তালিকায় নাম রয়েছে ২০, বরিশাল বিভাগে ১৫, সিলেট বিভাগে ২০, রংপুর বিভাগে ২৫ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ২০ জনের। চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে ৭২ জনের নাম।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত মাদকাসক্ত হয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে (রিহ্যাব) গেছেন অন্তত ৫০ হাজার মাদকসেবী। পাঁচ বছরে রিহ্যাবে চিকিৎসা নেওয়া নারী মাদকাসক্ত বেড়েছে পাঁচ গুণ। আর ১৫ ও তার কম বয়সি মাদকাসক্ত বেড়ে হয়েছে তিন গুণ, সংখ্যায় যা ৪৭ হাজার ৩৭৬। বহুলপ্রচলিত মাদকের পাশাপাশি দেশে আসছে নতুন নতুন প্রাণঘাতী ড্রাগ। দেড় যুগ আগেও এলএসডি, ব্রাউনি, আইস, এমডিএমএর মতো ড্রাগ দেশের মানুষের কাছে অনেকটা অচেনা থাকলেও এগুলোর নাম এখন মাদক সেবনকারীদের মুখে মুখে। নগরের গি ছাড়িয়ে এসব মাদক এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত দেড় দশকে দেশে শনাক্ত ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে শুধু সাত পদের যে পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয়েছে, এর মূল্য প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। যদিও সংশ্লিষ্টদের মতে, উদ্ধার হওয়া এসব মাদক দেশে ছড়িয়ে পড়া মোট মাদকের ২০-২৫ শতাংশের বেশি নয়।
ডিএনসির রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা ডিএনসি প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এরই মধ্যে অনেক সফলতা এসেছে।’