বন্যা-পরবর্তী বেরিয়ে আসছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। এ বাস্তবতাকে সামনে রেখে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সামনে এখন অপেক্ষা করছে টিকে থাকার প্রশ্ন। সবার সামনেই নতুন এক লড়াই। বন্যা-পরবর্তী আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কুমিল্লা : কুমিল্লার ১৭ উপজেলার মধ্যে ১৪টি বন্যায় আক্রান্ত হয়। লাকসাম, মনোহরগঞ্জ ও নাঙ্গলকোটের বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখনো পানিবন্দি। বিভিন্ন এলাকায় হেলে পড়েছে ঘর। এতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা বলে দাবি কুমিল্লা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের। এদিকে খালের বাঁধ কেটে জলাবদ্ধতা দূর ও ঘর সংস্কারের দাবি তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
গত ১৬ আগস্ট থেকে কুমিল্লা দক্ষিণের উপজেলাগুলোতে বন্যা শুরু হয়। ফেনীর বন্যার পানিতে ডুবে চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট ও বরুড়া উপজেলার বিভিন্ন অংশ। ২২ আগস্ট রাতে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া গ্রামে গোমতী নদীর ১১০ মিটার বাঁধ ভাঙে। এতে পানিতে তলিয়ে যায় বুড়িচং উপজেলার ১০৫টি গ্রাম। এরপর প্লাবিত হতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম। সেই পানি ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবিদ্বার উপজেলায় ছড়িয়ে বেশির ভাগ গ্রাম ডুবে যায়।
কুমিল্লা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বন্যায় কুমিল্লার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১৪ উপজেলার প্রায় ১১ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় ছিল। মোট ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৮২ হাজার ৭৫৫টি ঘর। এর মধ্যে ৮ হাজার ৬৭৪টি ঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাকিগুলো আংশিক। বন্যায় পানিতে ভেসে যায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মাছ। ভেসে যায় শাকসবজির বাগান, নার্সারি। মোট ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। বুড়িচংয়ে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আসবাব মাটিতে মিশে গেছে। নদীপাড়ের ভবনের ইট খুলে স্রোতের তোড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে। মাটিতে মিশে গেছে মাটির ঘর। চারদিকে দগদগে ক্ষত আর নিদারুণ হাহাকার। পরনে থাকা কাপড় ছাড়া অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি। মাথার নিচের বালিশও ভেসে গেছে বানের স্রোতে। ডুবেছে ফসলের জমি। ভেসে গেছে মাছের ঘের।
রাঙামাটি : টানা দুই দফায় বন্যাকবলিত হয়েছেন পাহাড়ের মানুষ। এ সময় ডুবেছে বসতঘর, ফসলি জমি, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। তছনছ হয়ে যায় আয় উপার্জন। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, বসতঘর কোনোরকম মেরামত করে থাকার উপযোগী করা গেলেও কৃষি খাতে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব।
জানা গেছে, প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয় পাহাড়বাসীকে। কখনো খরা, কখনো বন্যা। আবার কখনো অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ধস। তাই সব মৌসুমে থাকে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ। এমন চ্যালেঞ্জ সঙ্গে নিয়ে চলে পাহাড়বাসীর জীবন ও জীবিকা। সম্প্রতি অতিবৃষ্টি আর সীমান্তের পাহাড়ি ঢলে ডুবে যায় রাঙামাটির ছয়টি উপজেলার নিম্নাঞ্চল। বানের পানিতে ভেসে যায় বসতঘর, ভিটেমাটি, দোকানপাট, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আর স্বপ্নের ফসল ও জমি। পাহাড়ে কোনোরকম আশ্রয় নিয়ে বানভাসিরা বেঁচে থাকলেও চোখের সামনে রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদের গর্ভে বিলীন হয়েছে দীর্ঘ বছরের উপার্জিত সম্বল। সব হারিয়ে নিঃস্ব বানভাসিরা। সরকারিভাবে ত্রাণ পেলেও সহায়তায় এগিয়ে আসেনি কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
লক্ষ্মীপুর : দীর্ঘ মেয়াদি বন্যার কবলে পড়েছে লক্ষ্মীপুর। এরই মধ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জেলার বাসিন্দাদের। উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম কৃষি ও মৎস্য খাতও তছনছ হয়ে গেছে। স্বপ্ন ভেঙে গেছে বহু মানুষের। কেউ ঘর হারিয়েছেন, কেউ গবাদি পশু, স্বপ্নের মাছ ও কৃষি ফসল হারিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছেন। অনেকে অর্ধাহারে অনাহারে জীবনযাপন করছেন। টানা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ঢলের পানি আর বৃষ্টির পানির জলাবদ্ধতায় পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ জীবনযুদ্ধে লড়ছেন হাজারো পরিবার। এখনো ১ লাখ ২১ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে।
মৌলভীবাজার : বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা মৌলভীবাজার জেলায় চলতি বর্ষা মৌসুমে পর পর চারবারের বন্যায় জেলায় প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সড়ক বিভাগ, নদী ও হাওর পাড়ের মানুষ ও কৃষিজমির। শুধু সড়ক বিভাগের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার।