ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ার সম্ভাবনা না থাকলেও সচল ইভিএমসহ নির্বাচনি মালামাল সংরক্ষণে নতুন চিন্তা করছে নির্বাচন কমিশন-ইসি।
এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের সংস্কার পরিকল্পনায় অগ্রধিকার পাচ্ছে নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার। গত ১২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ইসির পাঠানো সংস্কার পরিকল্পনায় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ থেকে শুরু করে ফলাফল প্রস্তুতসহ সব পর্যায়ে ইভিএম, ফলাফল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার ও ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারসহ প্রযুক্তির ব্যবহার করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইভিএমসহ নির্বাচনি মালামাল সংরক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশনের ১০টি অঞ্চলে ওয়্যারহাউস নির্মাণের পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করা হয় সেই সংস্কার পরিকল্পনায়। এ ক্ষেত্রে আগামী বছরের ১ অক্টোবরের মধ্যে ওয়্যারহাউস নির্মাণ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।
ইভিএম সংরক্ষণে অঞ্চলভিত্তিক ওয়্যারহাউস নির্মাণে জমিও খুঁজছে ইসি। এজন্য বিভাগীয় কমিশনার ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা অঞ্চলে প্রথম ওয়্যারহাউস নির্মাণের মাধ্যমে এ কাজ শুরু করতে চায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। এ জন্য ঢাকার মিরপুরের ইসিবি চত্বর এলাকায় ৫৭ শতাংশ খাসজমির বরাদ্দ পেতে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ইসির একটি টিম সেই জমি পরিদর্শনও করেছে। এ ছাড়া বাকি ৯টি প্রশাসনিক অঞ্চল- রংপুর, রাজশাহী, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমি খোঁজা হচ্ছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সচিব শফিউল আজিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা আপাতত ইভিএমসহ নির্বাচনি মালামাল সংরক্ষণের জন্য ১০টি অঞ্চলে গোডাউন তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি। এ ক্ষেত্রে ইভিএম থাকতে পারে আবার সামনে অন্য প্রযুক্তিও আসতে পারে। তাই সব কিছু চিন্তায় রেখে আামরা কাজ করছি। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে-পরে নির্বাচনি মালামাল সংরক্ষণ নিয়ে চরম বিপদে পড়তে হয়। বেশি দামে জায়গা ভাড়া করতে হয়। শুধু ইভিএম নয়, নির্বাচনি মালামাল সংরক্ষণের জন্য যদি আলাদা জায়গা না থাকে; তবে স্কুল, কলেজ ও অডিটরিয়ামে নির্বাচনি মালামাল রাখতে হয়। স্কুল-কলেজের পরীক্ষা শুরু হলে এগুলো আবার অন্য জায়গায় রাখতে হয়। তাই ইসিবি চত্বর এলাকায় জমি বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা জমিটা দেখে এসেছি; এ বিষয়ে তাগিদও দিয়েছি। আমরা চাই অন্তত ঢাকায় গোডাউন নির্মাণের মাধ্যমে এই কাজ শুরু করতে।
ইসির এক সভায় কর্মকর্তারা জানান, সংরক্ষিত ইভিএমগুলো যাচাই করে দেখা গেছে এর অনেকগুলোই ব্যবহার অনুপযোগী অবস্থায় আছে। এসব ইভিএম যাচাইবাছাই সাপেক্ষে বিনষ্ট করা প্রয়োজন। এ ছাড়া ১০টি অঞ্চলে ইভিএম সংরক্ষণের জন্য ওয়্যারহাউজ তৈরি করা প্রয়োজন। এজন্য ওয়্যারহাউজের একটি খসড়া ডিজাইন প্রকল্প কার্যালয় হতে মাঠপর্যায়ে দেওয়া প্রয়োজন। ওয়্যারহাউজ তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জমি এবং অন্যান্য খরচের দরকার হবে। এজন্য ইভিএম প্রকল্প এবং মাঠ কার্যালয়ের সমন্বয়ে একটি ব্যয় প্রাক্কলন প্রস্তুত করে কমিশন সচিবালয়ের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা যেতে পারে।
বিগত ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দেশের ভোট ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে। সে সময় তারা বুয়েট থেকে ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে মেশিন তৈরি করে নেয়। ওই কমিশনের ধারাবাহিকতায় পরে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনও ভোট যন্ত্রটি ব্যবহার করে। তবে ২০১৫ সালে রাজশাহী সিটি নির্বাচনে একটি মেশিন অচল হয়ে পড়ায় তা আর ব্যবহার উপযোগী করতে পারেনি রকিব কমিশন। পরে তারা বুয়েটের তৈরি স্বল্প মূলের ওই মেশিনগুলো পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় ও উন্নত মানের ইভিএম তৈরির পরিকল্পনা রেখে যায়। ২০১৭ সালে কে এম নূরুল হুদার কমিশন এসে বুয়েটের তৈরি ইভিএমের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বেশি দামে মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক পূর্বে উন্নতমানের ইভিএম তৈরি করে নেন তারা। এতে মেশিন প্রতি ব্যয় হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো। হাতে নেওয়া হয় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প। সেই প্রকল্প থেকে দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়।
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এসে প্রায় প্রতিটি সেটেই কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় ৪০ হাজারের মতো মেশিন ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যায়। অবশিষ্ট ১ লাখ ১০ হাজার মেশিনের মধ্যে অধিকাংশগুলোতে ধরা পড়ে নানা ধরনের ত্রুটি। কিন্তু মেরামতের জন্য ছিল না নতুন কোনো অর্থের জোগান। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার ইভিএম অচল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। অকেজো মেশিন মেরামত, সংরক্ষণ প্রভৃতির জন্য সাড়ে ১২ শ কোটি টাকার প্রস্তাব দিলে বৈশ্বিক অর্থ সংকটের কারণ দেখিয়ে সরকার সেটি নাকচ করে দেয়। বর্তমানে অকেজো ইভিএমের সংখ্যা আরও বেড়েছে।
অন্যদিকে বিগত কমিশনের সময় গত জুনে নতুন করে ব্যয় না বাড়িয়ে অবশিষ্ট অর্থ দিয়ে প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আবেদন করে সরকারের অনুমতি চাওয়া হয়। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে মৌখিক সম্মতি জানানো হয়। ফলে সচল ছিল প্রকল্পের কার্যক্রম। বর্তমানে এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়বে কি না তা এখনো জানে না ইসি। ইসি সচিবালয় থেকে বারবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলেও এখনো কিছু স্পষ্ট করে বলা হয়নি।