রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ২০০৮ সালে সম্পদশালী না হলেও গত ১৬ বছরে তিনি হয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে গড়েছেন বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাগানবাড়িসহ ব্যাপক সম্পদ। চারঘাট-বাঘায় পোশাক কারখানা স্থাপনের কথা বলে স্বল্পমূল্যে কিনেছেন কয়েক কোটি টাকার জমি। সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে হলফনামার তথ্যে যে সম্পদ দেখিয়েছেন, তার চেয়ে কয়েক শ গুণ সম্পদ বেড়েছে গত ১৬ বছরে। ইতোমধ্যে শাহরিয়ার আলমের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাঘা উপজেলার এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, গত ৪ আগস্ট বিকালেও শাহরিয়ার আলম বাঘা উপজেলার আড়ানীর বাসায় ছিলেন। সন্ধ্যার পর থেকে আর কোনো নেতা-কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি তিনি। নিজের গাড়ি ঢাকায় পাঠিয়ে তিনি ৫ আগস্ট ভোরে বাঘার আরেক নেতার গাড়িতে চড়ে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে যশোরের গেদে বর্ডারে পৌঁছান। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে এখন তিনি রাশিয়ায় অবস্থান করছেন।
জানা গেছে, শাহরিয়ার আলম গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের বসন্তপুর মোড়ের পাশে গড়ে তোলেন নর্থ বেঙ্গল এগ্রো ফার্মস লিমিটেড নামের কৃষি খামার। ৫২ বিঘার খামারটির মালিক তিনি। এর মধ্যে ১২ বিঘা জমি খাস। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চৌধুরীহাট এলাকায় ২০১০ সালে ২৫ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার। লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়ও ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি কিনে সেখানেও গড়ে তোলেন খামারবাড়ি। সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের টিকিটে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি হন শাহরিয়ার। এ সময় হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল সব মিলিয়ে ২ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার। বিভিন্ন কোম্পানির নামে ঋণ ছিল ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ টাকা। ২০২৪ সালের নির্বাচনে অস্থাবর সম্পদ দেখান ৮৯ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৯৭৩ টাকা। নিজের কোম্পানির নামে থাকা ৭৬ কোটি টাকার ঋণও পরিশোধ দেখান। অর্থাৎ এই সময়ে তিনি অন্তত ১৬৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুই ছেলের অস্থাবর সম্পদ ছিল মাত্র ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৬৬২ টাকা। পাঁচ বছরেই তাদের অস্থাবর সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৭ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ৪৮২ টাকা।
জানা গেছে, চারঘাট-বাঘা মহাসড়কের পাশে মেরামতপুর এলাকায় অবস্থিত লিলি সিনেমা হল ২০১০ সালে বন্ধ হয়ে গেলে হল মালিকরা ভবনসহ জমিটি বিক্রির উদ্যোগ নেন। ঢাকার এক সিনেমা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান হলটি কিনে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেয়। ২০১৪ সালে শাহরিয়ার আলম প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর সিনেমা হলের জায়গাটি কিনে সেখানে গার্মেন্ট গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। সিনেমা হলের ৩৭ শতক জমি ভবনসহ কোটি টাকায় কেনার মানুষ থাকলেও গার্মেন্ট করার প্রলোভন দেখিয়ে হল মালিকদের কয়েকজন অংশীদারকে রাজি করান শাহরিয়ার আলম। পরে বাকি অংশীদারদের চাপে ফেলে মাত্র ৫০ লাখ টাকায় ৩৩ শতক জমি ও ভবনসহ সিনেমা হল কিনে নেন তিনি। কিন্তু সেখানে কোনো গার্মেন্টের একটি পিলারও ওঠেনি।
২০২২ সালে চারঘাট সদরে উপজেলা ভূমি অফিসের পূর্ব পাশে বিশ্বনাথ রমেকা নামে এক ব্যক্তির কাছে থেকে ৩৩ শতাংশ জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। এ ছাড়াও বাঘা, লালপুর ও ঈশ্বরদীতে বিভিন্ন নামে-বেনামে শাহরিয়ার আলমের আরও জমি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে।
নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের এক নেতার কন্যা সিলভিয়া পারভীন লেনিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন শাহরিয়ার আলম। দ্বিতীয় স্ত্রী লেনির মা রোকসানা মতার্ত্তুজা লিলিকে ২০২১ সালে মেয়র বানান শাহরিয়ার আলম। দ্বিতীয় স্ত্রী লেনিকে লালপুরে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি করে দেন শাহরিয়ার। ঢাকার গুলশানে ৩ হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের রাজকীয় একটি ফ্ল্যাট উপহার দেন দ্বিতীয় স্ত্রীকে। একই সময় গুলশানে নিজের নামে দুটি ও ছেলের নামে একটি ফ্ল্যাট কেনেন তিনি। নিজের নামে কৃষি ও অকৃষি জমি দেখিয়েছেন ৫১ বিঘা। অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য মতে, তখন শাহরিয়ার আলমের স্থাবর কোনো সম্পদ ছিল না। এ ছাড়া ২০২০ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের বসন্তপুর মোড়ের পাশে একই প্লটে ৪০ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। ওই জমির মালিক ছিলেন বাঘা উপজেলার বাঘা পেট্রলপাম্পের মালিক গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগ, জমির মূল্য পরিশোধ না করে শাহরিয়ার আলম দখল নিয়েছেন সেই জমি। ওই প্লটে নর্থ বেঙ্গল এগ্রো ফার্মস লিমিটেড গড়ে তুলেছেন। খামারবাড়ি করেছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চৌধুরীহাট এলাকায়। এমপি হওয়ার পর ২০১০ সালে ২৫ বিঘা জমি কেনেন সেখানে। ২৫ বিঘা জমি কিনলেও আরও ১০ বিঘা খাস জমি দখল করেছেন তিনি। সেখানে গড়ে তুলেছেন বাংলো বাড়ি, গরুর খামার, টিস্যু কালচার ল্যাব, বনসাঁই গবেষণাগার। লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়ও ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার। সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে খামারবাড়ি। বিভিন্ন দামি সবজি, মাছসহ নানা ধরনের চাষাবাদ করা হচ্ছে সেখানে।
এ ছাড়া রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনেও খুলেছেন নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গড়েছেন আটটি পোশাক কারখানা। তার নামে আছে একটি টেলিভিশন চ্যানেল, রাজশাহীতে গড়ে তুলেছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। শাহরিয়ার আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবার আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হওয়ার সময় ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা দামের হোন্ডা সিআরভি মডেলের গাড়িতে এবং স্ত্রী ২৭ লাখ টাকা দামের নিশান এক্স-ট্রায়াল গাড়িতে চড়তেন। সর্বশেষ তাকে ১ কোটি ১ লাখ ৩ হাজার ১০০ টাকা দামের লাক্সারি গাড়িতে এবং তার স্ত্রীকে ১ কোটি ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৫৭৫ টাকা দামের গাড়িতে চড়তে দেখা যায়।