গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া, বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং শ্রমিকদের নামে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন শ্রমিকরা।
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, চারটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছেন। তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ ও কোনাবাড়ী-কাশিমপুর সড়ক অবরোধ করেন। কোনাবাড়ী এলাকার যমুনা গ্রুপের যমুনা ডেনিমস লিমিটেড, দক্ষিণ সালনার পলাশটেক এলাকার এইচআর ওয়ান ফ্যাশন লিমিটেড ও এইচআর ওয়ান অ্যাকসেসরিজ কারখানা এবং মেম্বারবাড়ী এলাকার সিলকেন সুইং লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ ও অবরোধ করেন।
পুলিশ, আন্দোলনরত কর্মচারী-শ্রমিক ও স্থানীয়রা জানান, যমুনা ডেনিমস লিমিটেডের উৎপাদন ফ্লোরে কর্মরত সুপারভাইজার, ইনচার্জ, ডিস্ট্রিবিউটরসহ শ্রমিকরা গতকাল সকাল ৮টার দিকে কারখানার গেটে জড়ো হতে থাকেন। তারা কারখানায় কাজে যোগ না দিয়ে কর্মবিরতি শুরু করেন। এ সময় তারা প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী বেতন-ভাতা, হাজিরা বোনাস ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি এবং চাকরির বয়স ছয় মাস হলে বেসিক সমপরিমাণ ঈদ বোনাস প্রদানসহ ১৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায়ে পাশের কোনাবাড়ী-কাশিমপুর সড়ক অবরোধ করেন। এতে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। শিল্পপুলিশ, থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে আন্দোলনরতদের বুঝিয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে যান চলাচল শুরু হয়।
যমুনা ডেনিমস লিমিটেডের কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার সেলিম রেজা বলেন, ‘দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে আট-দশ জনকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা প্রস্তাব না মেনে কারখানার প্রধান ফটক অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করেন। তারা অন্য শ্রমিকদেরও কারখানায় প্রবেশে বাধা দেন। এ সময় ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী, শিল্পপুলিশ ছিল।’
গাজীপুর শিল্পপুলিশ-২-এর সহকারী পুলিশ সুপার (কোনাবাড়ী জোন) জাহাঙ্গীর আলম জানান, সকালে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কারখানায় প্রবেশ না করে প্রধান ফটকে ১৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তারা কোনাবাড়ী-কাশিমপুর সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
গাজীপুর সদর উপজেলার মেম্বারবাড়ী এলাকায় সিলকেন সুইং লিমিটেডের শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে নানা অজুহাতে দুর্ব্যবহার ও হয়রানি করার অভিযোগে কারখানার কয়েকজন কর্মকর্তার অপসারণ, বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ ১৮ দফা দাবিতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছেন। তারা প্রায় ৪ ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন।
জয়দেবপুর থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল হালিম জানান, শ্রমিকরা মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকায় সড়কের উভয় পাশে প্রায় ৫ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে কর্তৃপক্ষ গতকাল কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছেন। মহানগরের দক্ষিণ সালনার পলাশটেক এলাকার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা এইচআর ওয়ান ফ্যাশন লিমিটেড ও এইচআর ওয়ান অ্যাকসেসরিজ কারখানা খুলে দেওয়া ও তিন মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ওই দুই কারখানার শ্রমিকরা। তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। শিল্পপুলিশ, থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আন্দোলনরতদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। গাজীপুর শিল্পপুলিশের পরিদর্শক ফারুক বলেন, শ্রমিকদের বোঝালে তারা সড়ক ছেড়ে কারখানার সামনে অবস্থান নেন। সাভার প্রতিনিধি জানান, আশুলিয়ায় বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া ও বেতন বৃদ্ধিসহ শ্রমিকদের নামে মামলা প্রত্যাহার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। গতকাল সকাল ৮টার দিকে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের জিরাবোয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় লুসাকা কারখানার শ্রমিকরা। পরে তাদের সঙ্গে ম ল গ্রুপ ও ম্যাংগো ট্যাক্সের শ্রমিকরাও যোগ দেন।
আশুলিয়া শিল্পপুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে আশুলিয়ার মোট ৪৯টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে শ্রম আইন ২০০৬-এর ১৩(১) ধারায় ১০টি কারখানা বন্ধ রয়েছে এবং বাকি গুলোয় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
শিল্পপুলিশ জানায়, সকালে লুসাকা গ্রুপের শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরুর পর জিরাবোর ম ল নিটওয়্যার লিমিটেডের শ্রমিকরাও সড়কে নেমে এসে আন্দোলন শুরু করেন। লুসাকা গ্রুপের শ্রমিকরা জানান, ৯ সেপ্টেম্বর মালিকপক্ষ কারখানার ২৭ শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে আশুলিয়া থানায় মামলা করে। পরে শ্রমিকরা মামলা প্রত্যাহার দাবিতে আন্দোলন করলে গত বৃহস্পতিবার কারখানা খুলে দেওয়ার পর মালিকপক্ষ মামলা প্রত্যাহার করে আমাদের হাতে কপি দেবে বললেও আর দেয়নি। মণ্ডল নিটওয়্যার লিমিটেডের আন্দোলনরত এক শ্রমিক জানান, বেতন বৃদ্ধিসহ কয়েকটি দাবিতে আমরা আন্দোলন করছিলাম। এর মধ্যে শনিবার কারখানায় এসে দেখি মালিকপক্ষ ১৩(১) ধারায় কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার থেকে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা মালিকপক্ষের হয়ে আমাদের মারধর করছে। বিভিন্ন সময় শ্রমিকদের ধরে নিয়ে মারধর করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদেই আমরা আন্দোলন করছি। এদিকে শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় বন্ধ কারখানার মধ্যে রয়েছে লুসাকা গ্রুপের বেক নিটওয়্যার লিমিটেড, বেক সোয়েটার লিমিটেড, ম ল নিটওয়্যার লিমিটেড, এনভয় গ্রুপের এনভয় ফ্যাশন লিমিটেড, এনভয় ডিজাইন লিমিটেড, আঞ্জুমান ডিজাইন লিমিটেড, দ্য রোজ ড্রেসেস লিমিটেড। এ ছাড়া সবেতন কারখানা ছুটি আছে, কাজ বন্ধ আছে কিংবা শ্রমিকরা চলে গেছেন এমন কারখানার মধ্যে রয়েছে ম্যাংগোটেক্স লিমিটেড, গ্লোরিয়াস সান ফ্যাশন, সাউদার্ন গার্মেন্টস লিমিটেড, টেক্সটাউন লিমিটেড, জেনারেশন নেক্স, স্কাইলাইন গার্মেন্টস লিমিটেড, স্কাইলাইন অ্যাপারেলস লিমিটেড, নিউ এইজ অ্যাপারেলস, নিউএইজ গার্মেন্টস, সিডকো লিমিটেড।
বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ : নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরীতে শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের টাকা পরিশোধ না করে কারখানা লে-অফ ঘোষণা করায় বিক্ষোভ মিছিলসহ সড়ক অবরোধ করেছে শ্রমিকরা। গতকাল সকালে ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত অবন্তী কালার টেক্স নামক গার্মেন্ট শ্রমিকরা এই সড়ক অবরোধ করে।
দীর্ঘ দুই ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখার ফলে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং যানজট সৃষ্টি হয়। তবে তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ায় শ্রমিকরা কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে পারেনি।
স্থানীয়রা জানান, সকালে বকেয়া বেতনের দাবিতে কয়েক শ শ্রমিক একত্রিত হয়ে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে নানা ধরনের স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাদের কত মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে তা শোনেন।
একপর্যায়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে বকেয়া বেতনের টাকা আদায়ের বিষয়ে আশ্বস্ত করে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়। এ সময় সেনাবাহিনী কয়েকজন শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করার আশ্বাস দেন।