‘নোবেল লরিয়েট প্রফেসর ইউনূস নাকি বাংলাদেশের সরকার প্রধান? উনি তো ক্লিনটন দম্পতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এটা তো বাংলাদেশের জন্য অনেক গর্বের। উনি তো অনেক বড় মানুষ।’ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে আসা একজন ফরাসি নাগরিকের বরাত দিয়ে এসব কথা বলছিলেন মানহ্যাটনে বাস করা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্যবসায়ী আসাদ মুরাদ। তিনি বলছিলেন, সম্প্রতি আমার অফিসে আসা ভিনদেশি ক্লায়েন্ট ড. ইউনূসের বিষয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
জ্যাকসন হাইটস-এর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্যবসায়ী তৌহিদুর রহমান বলছিলেন, ড. ইউনূস তো গ্লোবাল সিটিজেন। উনি কেবল বাংলাদেশের নাগরিক নন। তবে আফসোস, আমরা তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের উইনিংহাম বিশবিদ্যালয়ে তাঁর ছবিসংবলিত তোরণ বানানো হয়েছে। কলোরাডে মাউন্টেনে তাঁর ছবি আঁকা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের উচিত হবে, তাঁকে যথাযথ ব্যবহার করা। সম্প্রতি আরব আমিরাতে ৫৭ বাংলাদেশির বিষয়টা তো আমরা সবাই দেখেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরাও এর সুফল পেতে পারে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ায় স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা। তারা বলছেন, ড. ইউনূসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের বিষয়ে অন্যদের ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। দেশের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকরা ইতোমধ্যে এর সুফল ভোগ করতে শুরু করেছেন। তাদের ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসায় বাংলাদেশিদের সুযোগ প্রসারিত হবে। ভারত কিংবা এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো প্রকৌশলী, চিকিৎসক, নার্স এবং বিভিন্ন ট্রেডে দক্ষ জনশক্তি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে জনশক্তি রপ্তানিতে বিশেষ দৃষ্টি দিবেন।
ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রীতিমতো দ্যুতি ছড়িয়েছেন চার দিনের যুক্তরাষ্ট্র সফরে। সরকারপ্রধান হিসেবে ২৭ সেপ্টেম্বর তাঁর দেওয়া ভাষণ নানা মহলে আলোচিত হয়েছে। বিশ্ব নেতাদের প্রশংসায় ভেসেছেন। সারা বিশ্বের প্রবাসীদের মতো নিউইয়র্কে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ড. ইউনূস। গত ২৭ সেপ্টেম্বর দেশের উদ্দেশে নিউইয়র্ক ছেড়ে গেলেও এর রেশ যেন রয়ে গেছে এখনো। তবে প্রবাসীদের আক্ষেপ হলো, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত মনের কথাগুলো তাঁকে বলতে পারেননি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গ্রহণ করেছেন তাতে প্রবাসীদের ভাবনার মাত্রা বেড়ে গেছে বহু গুণ। তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় পর দেশ সঠিক পথে রয়েছে। ড. ইউনূস তাদের সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হবেন। নিউইয়র্ক, ভ্যারিজোনা, পেনসিলভানিয়া, মেরিল্যান্ড, বাফেলো-তে বসবাসরত অন্তত ২০ জন প্রবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের মতে, প্রবাসীদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারটি ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ফলে বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানির বদলে বিশেষ সেবা দেওয়া হচ্ছে। এই খবরে প্রবাসীরা দারুণ খুশি। যেহেতু এবারের সফরে তারা দাবি তুলে ধরতে পারেননি, তাই প্রবাসীদের পক্ষ থেকে দাবিগুলো স্থায়ী মিশন বা কনস্যুলেটের মাধ্যমে তার কাছে তুলে ধরা যেতে পারে বলে মনে করেন তারা। বিমানবন্দরে যেহেতু পরিবর্তন এসেছে, নিশ্চয় একে একে অন্যান্য পরিবর্তনও আসবে বলে তাদের বিশ্বাস।
যুক্তরাষ্ট্রের লং আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. শওকত আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত ১৫ বছর প্রবাসীদের কোনো এক্সেস ছিল না। দলীয় সিন্ডিকেটে আবদ্ধ ছিল সবকিছু। তিনি বলেন- প্রবাসীরা আনন্দিত এ জন্য যে, অত্যন্ত সুপরিচিত এবং দলনিরপেক্ষ একজন মানুষ আমাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। ড. ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের পরিচয় বেড়েছে। সম্মান বেড়েছে। সিভিল রিসিপশন বেড়েছে। ইতোমধ্যেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। যা অতীতে কখনো ছিল না। এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ট্যাক্স ট্যারিফ কম থাকলে বাণিজ্য বাড়বে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি কূটনৈতিক সূত্রে জেনেছি, আরও প্রায় ৮০টি দেশের রাষ্ট্রনায়কসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি এবং সংগঠন তাঁর অ্যাপয়েনমেন্ট চেয়েছিল। সেগুলো রিসিভ করলে আরও অন্তত এক মাস থাকতে হতো প্রফেসর ইউনূসকে। তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুন্দর রি-অ্যাকশন পাবে। ড. ইউনূস চাইলে অনেক কিছুই আদায় করা সম্ভব। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রবাসীরা তাদের অন্যান্য দাবি সম্পর্কে জানান, বাংলাদেশ কনস্যুলেট ও দূতাবাসের মাধ্যমে পরিচিতপত্র চালু (যা ব্রিটেনে চালু হয়েছে), কনস্যুলেট ও দূতাবাসের মাধ্যমে ভোটদান, পাসপোর্ট নবায়ন, জন্ম-মৃত্যু সনদ, দেশের সম্পত্তি হস্তান্তরে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মতো কাজ সহজ করা, দ্বৈত নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধ, প্রবাস থেকে যে কোনো বাংলাদেশির লাশ বিনা খরচে দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করা, প্রবাসী মন্ত্রণালয়কে কার্যকর করা ইত্যাদি। বাংলাদেশি স্টুডেন্ট অ্যান্ড অ্যালুমনি অ্যঅসোসিয়েশনের উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী আল আমিন রাসেল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রবাসীদের বিনিয়োগের বিষয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াটি অনেকেই জানেন না। বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের স্পষ্ট ফ্রেম ওয়ার্ক থাকা উচিত। একই সঙ্গে আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। নইলে কেন যাবেন বিদেশিরা কিংবা প্রবাসী বাংলাদেশিরা? দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে দাবি তুললেও কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। প্রবাসীরা বলছেন, এসাইলাম মামলা দ্রুত শেষ করতে বাইডেন প্রশাসন ৬০০ বিচারক নিয়োগ দিয়েছেন, তা অব্যাহত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করা। যারা টাকা পাচার করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এ ছাড়া নিউইয়র্ক-ঢাকা রুটে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করার বিষয়টি রয়েছে।