বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। রয়েছে রহস্যেঘেরা পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। আছে বৈচিত্র্যময় খাবার ও সংস্কৃতি, চোখজুড়ানো কাপ্তাই লেক, সবুজেঘেরা চা বাগান, মহাস্থানগড়, ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর মাজার, রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টসহ পর্যটক আকর্ষণ করার মতো হাজারো প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী উপাদান। তবুও বিদেশি পর্যটকের খরা কাটাতে পারছে না দেশ। বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও পর্যটন খাত থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রচারণা, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের পর্যটন খাত সামনে এগোতে পারছে না। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে যখন শুধু ইন্টারনেটে ছবি ও বর্ণনা দেখেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা, তখন পর্যটন দিবসকেন্দ্রিক কিছু র্যালি-সেমিনার ও পর্যটন মেলাতেই আটকে রয়েছে দেশের পর্যটন নিয়ে প্রচারণা। কতজন পর্যটক আসছে, যাচ্ছে তার হালনাগাদ সঠিক হিসাবই নেই কারও কাছে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, হাজার বছরের ঐতিহাসিক অসংখ্য নিদর্শনের খবরই জানে না বিশ্ববাসী। আবার যারা জানতে পারছেন, তারাও এখানে এসে পাচ্ছেন না পর্যটকবান্ধব পরিবেশ। মাত্রাতিরিক্ত আবাসন ব্যয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তার অভাব, ভিসা জটিলতা ছাড়াও পর্যটকদের বিনোদন দেওয়ার মতো সেবাগুলোও মিলছে না। পর্যটকরা চান দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে ব্যতিক্রমী কিছু। উন্নত বিশ্বের কোনো বিলিয়নিয়ার ভ্রমণে বের হয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে না উঠে পাহাড়ের চূড়ায় বা ভয়ংকর জঙ্গলে তাঁবু গাড়েন রাত যাপনের জন্য। এমন অ্যাডভেঞ্চারের ব্যবস্থাই নেই এখানে।
২০২২ সালে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে বিপর্যস্থ শ্রীলঙ্কা শুধু নীতিমালায় পরিবর্তন এনে এক বছরের মাথায় পর্যটন ও রেমিট্যান্সকে ভর করে ঘুরে দাঁড়ায়। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) চলতি বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পর্যটন খাত থেকে ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম আয়তনের দেশ শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ এশিয়ার অপর দেশগুলোর মধ্যে ভারত ২৯ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন, পাকিস্তান ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন, মালদ্বীপ ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ও নেপাল শূন্য দশমিক ৬৩৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। সেখানে বাংলাদেশের আয় শূন্য দশমিক ৪০১ বিলিয়ন ডলার।
শুধু তাই নয়, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ভ্রমণ ও পর্যটন সূচকে বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শেষে। এই সূচকে ৭ পয়েন্টের মধ্যে ৩ দশমিক ১৯ পেয়েছে বাংলাদেশ। যেসব মানদন্ডে এই বিচার করা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো করেছে পর্যটন ও ভ্রমণবিষয়ক সম্পদের মানদন্ডে। অর্থাৎ, বাংলাদেশে ভ্রমণ ও পর্যটনের যথেষ্ট উপকরণ থাকলেও পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে পর্যটকদের আকর্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে ট্রিপ এডভাইজর ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সারা বিশ্ব থেকে মানুষ হোটেল বুকিংসহ পর্যটনকেন্দ্রিক বিভিন্ন তথ্য জানতে পারেন। পর্যটকরা সেখানে বিভিন্ন ভ্রমণ গন্তব্য, হোটেল, দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে রিভিউ দেন। পর্যটকদের রিভিউয়ের ভিত্তিতে ২০২৪ সালেও ২৫টি আকর্ষণীয় গন্তব্য সম্পর্কে ওয়েবসাইটে বর্ণনা করা হয়েছে। পর্যটকরা সেখানে গিয়ে কী কী করতে পারবেন, কী কী সেবা পাবেন ও তার খরচের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। সেখানে নেই বাংলাদেশের নাম। রয়েছে ২৫টি আকর্ষণীয় সমুদ্রসৈকতের ছবিসহ বর্ণনা ও সেবার মূল্যতালিকা। সেখানেও নেই কক্সবাজার, কুয়াকাটা বা সেন্টমার্টিনের নাম। পর্যটকবান্ধব ২৫টি আকর্ষণীয় হোটেলের মধ্যে নেই বাংলাদেশের একটিও। দেখা গেছে, রেটিংয়ে শীর্ষ হোটেলগুলোর বড় অংশই বহুতল নয়, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে গাছ, পশু-পাখি দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে সাজানো হয়েছে। টিপটপ এসি রুম নয়, রেস্তোরাঁ বানানো হয়েছে বাগানের ভিতরে গাছের ছায়ায়। কিছু হোটেল নীরব জলের ওপরে মাচা তুলে তৈরি। খাবার বিচারে ২৫টি আকর্ষণীয় রেস্টুরেন্টের তালিকাতেও নেই বাংলাদেশের একটিও। স্কুবা ডাইভ, নৌ ভ্রমণ, এয়ার বেলুন রাইড, প্যারাসাইটিং, জঙ্গলে রাত্রিযাপন, মরুভূমির বুকে ধুলা উড়িয়ে গাড়ি চালনার মতো পর্যটকদের পছন্দের বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চারের তালিকায় নেই বাংলাদেশ। অথচ এর অধিকাংশ অ্যাডভেঞ্চার তৈরির সুযোগ দেশে রয়েছে বলে মনে করেন পর্যটন খাতের সঙ্গে জড়িতরা।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে ব্যবসায়িক পর্যটন নিয়ে কাজ করা বেঙ্গল লজিস্টিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম রফিকুল ইসলাম নাছিম বলেন, বিশ্বে ব্যাকপ্যাক পর্যটকই ৭৫ ভাগ। যারা সময় ও কিছুটা অর্থ হাতে এলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। এরা বয়সে তরুণ। অনেক টাকা খরচ করে হোটেলে ঘুমানোর জন্য তারা বের হন না। অতিরিক্ত খরচ, ভালো যোগাযোগের অভাব ও পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা না থাকায় এখানে ব্যাকপ্যাক ট্যুরিস্ট নেই বললে চলে। ট্যুরিস্ট টানতে হলে ট্যুরিস্টিক কর্মকান্ড বাড়াতে হবে।
কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্টের হোটেল ইলাফ ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল ম্যানেজার খায়রুল বলেন, শুধু স্পা করা বা কেনাকাটার জন্য সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকরা থাইল্যান্ডে ছুটে যায়। এ জন্য থাইল্যান্ডে সারা বছর পর্যটক থাকে। ফলে সেখানে হোটেল ভাড়াও কম। কক্সবাজারে শুধু সাগর দেখা ছাড়া বিনোদনের কিছু নেই। শীতকালে সমুদ্র ঠান্ডা থাকায় মূলত তিন মাস পর্যটকের চাপ বাড়ে। বাকি নয় মাস হোটেল ফাঁকা থাকে। এ জন্য আমরা হোটেল ভাড়া কমাতে পারি না। শুধু সাগর দেখতে বিদেশ থেকে মানুষ এখানে কেন আসবে?
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, আমাদের দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলো আন্তর্জাতিক মানের না। আমরা পর্যটন মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছি। তাতে সমগ্র বাংলাদেশকে আটটি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটা অঞ্চলের জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছি। পরিকল্পনা অনুযায়ী সারা দেশে পর্যটনের উন্নয়ন ঘটানো হবে। সেই সঙ্গে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশিদের বাংলাদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। আশা করছি ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রায় ৭৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।