ভেজাল আর নকলে সয়লাব দেশ। জীবন বাঁচাতে রোগীকে দেওয়া ওষুধেই অনেক সময় মৃত্যু হচ্ছে রোগীর। ফর্সা হতে ক্রিম ব্যবহার করে উল্টো ঝলসে যাচ্ছে ত্বক। প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ডের মোড়ক নকল করে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল পণ্য। বড় বড় সুপারশপেও শ্যাম্পু-তেল-পারফিউম বিক্রি হচ্ছে কোনোরকম নিরাপত্তা সিল ছাড়াই। নকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কারণে হরহামেশা ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রং ও রাসায়নিক। নিষ্পাপ শিশুর খাদ্যেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল। এতে স্বাস্থ্যগত ও আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মানুষ। ঘটছে অপমৃত্যু। বাড়ছে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা।
বছরের পর বছর প্রকাশ্যে এমন অনিয়ম চললেও সরকারের তদারকি সংস্থাগুলো যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্টান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) থেকে অনুমোদন নেওয়ার পর বাজারে পণ্যের মান বজায় রাখছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। তবে এ নিয়ে নেই কোনো তদারকি বা বাজার মনিটরিং। মাঝেমধ্যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ভেজালবিরোধী অভিযান চালানো হলেও দিনে দিনে ভেজালের বিস্তার বাড়ছেই। আর এমন বাস্তবতা সামনে রেখেই প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় নানা আয়োজনে আজ বিশ্ব মান দিবস পালন করতে যাচ্ছে বিএসটিআই।
সরেজমিন দেখা গেছে, পাউরুটির প্যাকেটে মেয়াদ থাকলেও ভিতরে ছত্রাক জমে গেছে। খেতেও তিতা স্বাদের ও কটু গন্ধযুক্ত। খিলক্ষেতের একটি দোকানে ৬ অক্টোবর বিক্রির জন্য রাখা পাউরুটির প্যাকেটে উৎপাদন তারিখ ৭ অক্টোবর দেখা গেছে। দোকানদার বলেন, বিক্রি না হওয়া পাউরুটি, বনরুটি কয়েকদিন পরে ফেরত নিয়ে যায়। এগুলো আবার নতুন ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে পাউরুটি বানায় কিনা জানা নেই।
এদিকে বিভিন্ন পণ্যের মোড়কে নিরাপত্তা সিল বাধ্যতামূলক হলেও সম্প্রতি রাজধানীর একাধিক মুদি দোকান ও দুটি সুপারশপ ঘুরে দেখা গেছে, থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বেবিশ্যাম্পু, বেবি শাওয়ার জেল, বেবি অয়েল, বেবিলোশন, বড়দের হেয়ার অয়েল, শ্যাম্পু, পারফিউমের অধিকাংশের বোতলেই নেই নিরাপত্তা সিল। এগুলোর মধ্যে দেশি নামকরা ব্রান্ডের পণ্য যেমন আছে, রয়েছে জনপ্রিয় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির পণ্যও। আছে আমদানি করা বিদেশি পণ্য। হাতেগোনা কিছু পণ্য বাদে অধিকাংশেরই মোড়কে নেই প্লাস্টিকের নিরাপত্তা সিল বা কিউসি স্টিকার। অনায়াসেই সেসব বোতল থেকে প্রসাধনী বের করা যায়, আবার ঢুকানো যায়। ফলে সেগুলো আসল না নকল তা যাচাইয়ের সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে খিলক্ষেত এলাকার দোকানদার আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা তো কোম্পানির লোক থেকে মাল নিই। তারা এভাবেই দেয়। আসল-নকল যাচাই তো আমরা করতে পারি না। অনেক সময় ক্রেতারা এটা জিজ্ঞেস করে। জাকারিয়া নামের এক ক্রেতা অভিযোগ করেন, শিশুর জন্য কিছু নিতে গেলে আমরা সর্বোচ্চ সচেতন থাকি। আমি সব সময় দেশে উৎপাদিত পণ্য কেনার চেষ্টা করি। অথচ, শুধু জনসন ও জাস্ট ফর বেবি ব্র্যান্ডের বেবি শ্যাম্পুর মুখ সিল করা দেখলাম। কডোমো টপ টু টো শাওয়ার জেল থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা বলা হলেও বোতলের মুখে সিল নেই। এগুলো খিলক্ষেতের কোনো ঘরের ভিতরে তৈরি হয় কিনা তা কীভাবে বুঝব? এ ছাড়া হেয়ার অয়েলের মুখ সিলছাড়া হয় কীভাবে? পরিবহনের সময় তো তেল পড়ে যেতে পারে। সহজে নকল হতে পারে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, ভোজ্য তেল, পশুখাদ্য, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম, শিশুখাদ্য, বেকারি পণ্য, খাবার পানি, প্রসাধনী থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ- সব কিছুতেই মেশানো হচ্ছে ভেজাল। ভেজাল জ্বালানি তেলের কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার গাড়ি। কিটক্যাট, লাভ ক্যান্ডি, রোলানা, সাফারি, ফাইভ স্টার, ক্যাডবেরি, বাবলিসহ বিশ্বখ্যাত নানা ব্র্যান্ডের চকলেট তৈরি হচ্ছে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকার টিনশেড ঘরে। শিশুদের পছন্দের এসব চকলেট হুবহু নকল করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সারা দেশে। তৈরি হচ্ছে জনসন অ্যান্ড জনসন, পন্ডস, কডমোসহ বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের কসমেটিক্স, বিদেশি পাউডার ড্রিঙ্কস, জুস, চিপস, ডায়াপারসহ বিভিন্ন পণ্যের নকল। এ ছাড়া পোলট্রি ফার্মের ডিমে পাওয়া গেছে ট্যানারি বর্জ্যরে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম। আটায় মেশানো হচ্ছে চক পাউডার বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট। মিষ্টিজাতীয় খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত রং, সোডা, স্যাকারিন ও মোম। কাপড়ের বিষাক্ত রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া মেশানো হচ্ছে খাবারের মসলায়। ফলমূল দ্রুত পাকিয়ে রঙিন বানাতে কার্বাইড, ইথোফেন আর পচন রোধে ফরমালিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে, ২ লাখ লোক কিডনি রোগে, দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা ১৫ লাখ বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করছেন একই কারণে।
ভেজাল প্রসাধনী নিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, সাবান, শ্যাম্পু, লোশন, স্কিন ক্রিম সবই নাক-মুখের কাছাকাছি ব্যবহৃত হয়। নকল প্রসাধনীতে বিপজ্জনক মাত্রায় মার্কারি, হাইড্রোকুইনোন, লেডসহ নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকতে পারে। এগুলো শুধু ত্বক নয়, নানাভাবে শরীরে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। শিশুদের ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। মা ব্যবহার করলে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হয়। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এদিকে বিভিন্ন পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, লাইসেন্স প্রদান ও বাজার তদারকি করে বিএসটিআই। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (মান) মো. সাইদুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২৯৯টি পণ্যের বাধ্যতামূলক মান সনদ নিতে হয়। এগুলো আমরা কঠোরভাবে মনিটর করি। বেকারিপণ্য, প্রসাধনী, শিশুখাদ্য- এগুলো সবই বাধ্যতামূলক পণ্যের আওতায়। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিত বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। জেল-জরিমানাও করছি। প্রসাধনীর বোতলে সিল করা বাধ্যতামূলক। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব।