দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অর্থনৈতিকভাবে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ সার্বিয়া বিদেশি কর্মী খুঁজছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফ্যাক্টরি ও নির্মাণশিল্পে কর্মীনির্ভর খাতে সংকট কাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটি। পাশাপাশি বিশাল কর্মযজ্ঞের ইউরো-এক্সপো আয়োজন করতে যাচ্ছে সার্বিয়া। এজন্য প্রয়োজন বিশালসংখ্যক নির্মাণকর্মী নিয়োগ। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে বড় আকারে বিদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। এতদিনের জটিল অভিবাসননীতি অনেকাংশেই সহজ করে এনেছে তারা। বাংলাদেশের জন্যও তৈরি হয়েছে সুযোগ।
প্রায় একই পরিস্থিতি দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের আরেক দেশ নর্থ মেসিডোনিয়ায়। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আইটি, মেডিকেল, কৃষি ও নির্মাণ খাতে শ্রমিক নেওয়ার জন্য চলতি বছরেই প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহের কথাও জানায় নর্থ মেসিডোনিয়া। তৎকালীন সরকারের কাছে সমঝোতা স্মারকের জন্য নমুনাও চেয়েছিল দেশটি। কিন্তু পরে আর সে বিষয়ে হয়নি কোনো অগ্রগতি।
অন্যদিকে, মাত্র সাড়ে তিন বছরে ৩৫ হাজারের বেশি শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছিলেন পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়ায়। সহজে ভিসা প্রাপ্তি এবং কাজের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের পছন্দের গন্তব্য হয়ে ওঠে দেশটি। ঢাকায় প্রতিনিধি পাঠিয়ে অস্থায়ী ভিসা সেন্টার স্থাপন করে ভিসা দেওয়ার মতো পদক্ষেপও নিয়েছিল রোমানিয়া। তবে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তৎকালীন দুর্নীতিপরায়ণ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে বন্ধ হয়ে যায় ভিসা সেন্টারটি। রোমানিয়ার শ্রমবাজারের আশার আলো নিভে যায়। ভারতে গিয়ে ভিসা সংগ্রহের সংকটেও আটকে যায় অনেক আবেদন। অনেক ভিসাও পরে বাতিল হয়ে যায়। শ্রমবাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্বিয়া, নর্থ মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রোর মতো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের দারুণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতদিন খুব স্বল্প পরিমাণে জনশক্তি পাঠানো সম্ভব হলেও এখন এখানকার কৃষি, গার্মেন্ট, ফ্যাক্টরি, হোটেলগুলোয় হাজারে হাজারে কর্মী পাঠানো সম্ভব হবে। ন্যূনতম ৫৫০ ইউরো থেকে ৮৫০ ইউরোয় কাজের সুযোগ রয়েছে এসব দেশে। পাশাপাশি ভিসার জন্য অন্য কোনো দেশে যেতে না হওয়াও দেখা দিয়েছে একটি বিশেষ সুযোগ হিসেবে। তবে পূর্ব ইউরোপের শ্রমবাজারের সুযোগের জন্য প্রয়োজন রয়েছে বেশ কিছু উদ্যোগের। কারণ পূর্ব ইউরোপের এসব দেশ থেকে বাংলাদেশিদের পালিয়ে ইউরোপের অন্য দেশে প্রবেশের প্রবণতা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে রোমানিয়ার সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতার কারণে। পূর্ব ইউরোপ ও বলকান রাষ্ট্রগুলো নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, পূর্ব ইউরোপের শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য বিপুল সম্ভাবনাময়। উদাহরণ হিসেবে শুধু সার্বিয়াই প্রায় ১ লাখ দক্ষ বিদেশি কর্মীর ভিসা ইস্যু করেছে। কারণ ২০২৭ সালে ইউরো এক্সপো আয়োজনের জন্য তাদের ৫ লাখ নির্মাণশ্রমিক প্রয়োজন। এ কর্মীর চাহিদা বৈধ পথে পূরণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া প্রতি বছর ৩০ হাজার সার্ব নাগরিক বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। যাদের মধ্যে বড় একটি অংশই তরুণ। এজন্য তাদের এমনিতে কর্মী সংকট তৈরি হয়। এজন্য নতুনভাবে কর্মী নেওয়ার উদ্যোগ আছে সার্বিয়ার। ২০২৩ সালে অন্তত ৫০ হাজার অভিবাসী বৈধভাবে সার্বিয়ার কাজের ভিসা পেয়েছেন। পরিবহন খাতে সংকট কাটাতে শ্রীলঙ্কা থেকে বাস ড্রাইভার নেওয়া হয়েছে সার্বিয়ায়। ভারত থেকে নেওয়া হয়েছে রেস্টুরেন্টের শেফ। নেপাল থেকেও কর্মী নেওয়া হয়েছে। তাই এখন সার্বিয়ার শ্রমবাজার ধরতে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টদের দ্রুত উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। না হলে বিশ্বের অন্যান্য শ্রমবাজারের মতো সার্বিয়াদের নেপালি, ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কানদের কাছে হারাতে হতে পারে সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। তিনি জানান, পূর্ব ইউরোপে বাংলাদেশিদের জন্য বড় শ্রমবাজার তৈরি করতে কয়েকটি দেশের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা চালিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। হয়েছে বেশ কয়েকটি বৈঠকও। বলকান রাষ্ট্রগুলো চায় অবৈধভাবে বসবাসকারীদের ফেরত পাঠাতে। এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তাদের ওপর চাপ রয়েছে। এসব নিয়ে তারা আলোচনা করতে যায়। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন তাই নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ আছে।
ইউরোপের শ্রমবাজার নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে কাজ করা বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি এশিয়া কন্টিনেন্টাল গ্রুপ বিডির স্বত্বাধিকারী লোকমান শাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইমেজ কাজে লাগানোর দারুণ সুযোগ আছে। ড. ইউনূসকে সামনে রেখে শ্রমবাজার নিয়ে আলোচনা হলে পূর্ব ইউরোপের শ্রমবাজার ভারত ও নেপালের হাতে চলে যাওয়া ঠেকানো সম্ভব। এর মাধ্যমে তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের বড় বিকল্প শ্রমবাজার। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপিতেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে পূর্ব ইউরোপের নতুন শ্রমবাজার।