ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরু বলেছেন, দুই বছরের জন্য একটা জাতীয় ঐক্যমতের সরকার প্রয়োজন, যারা রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন এনে একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবে। ছয় মাস-এক বছরের মধ্যে নির্বাচন হলে বিদ্যমান ব্যবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হবে না।
নুর বলেন, এই সরকার একটি অরাজনৈতিক ও বিপ্লবী সরকার। রাষ্ট্র পরিচালনা একটি রাজনীতি। অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে পরিপূর্ণভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। এনজিও মার্কা চেহারা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব নয়। তাই অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের পরিধি বাড়িয়ে বিভিন্ন দল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে একটি ইনক্লুসিভ সরকার গঠন করা উচিৎ। অন্যথায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দূরত্ব থাকলে আমরা দুই বছর বললেও এই সরকারের ছয় মাস টিকে থাকা মুশকিল হবে।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিবাদী সরকারের সহযোগিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে আইন করে দশ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। যাতে এটি পরবর্তীর প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। পতিত সরকারের আমলে ছাত্রলীগ যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিৎ। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কারসাজির মাধ্যমে নির্বাচিত ১১ জনের মধ্যে ভিপি হিসেবে আমিসহ মাত্র দু’জনকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। ভোট গণনায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য সেই সময় ভোররাতে ভোটের ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
শনিবার রাজধানীর এফডিসিতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে এসব কথা বলেন নুর।
সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান বলেন, বিগত আওয়ামী সরকারের ছাত্র সংগঠন গত ১৫ বছরে শিক্ষাঙ্গণে ছাত্র রাজনীতির নামে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিল তা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। এখন ছাত্র রাজনীতির কথা শুনলেই ভয় হয়। ছাত্রলীগের বিগত সময়ে নানা কর্মকাণ্ড আমাদের শঙ্কিত করে তোলে। ছাত্র রাজনীতির কথা ভাবতেই মনে হয় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণসহ সব ধরনের অপকর্ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হল দখল, সিট দখল, গণরুমে নির্যাতন, র্যাগিং অতি সাধারণ কর্মকাণ্ডে পরিণত করেছিল ছাত্রলীগ। ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিছিলে নিয়ে যাওয়া, দলীয় দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করা, হলে মাদকের ব্যবসা, বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অস্ত্র ভাড়া দেওয়াসহ বহুমুখী অপকর্মে জড়িত ছিল তৎকালীন ক্ষমতাশীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ।
তিনি আরও বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব নিয়োগের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের দেওয়া তালিকা থেকে নিয়োগ দিতে হতো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল উন্নয়ন কাজে পার্সেন্টেজ নিত তারা। ঠিকাদারি কাজ কারা পাবে প্রশাসনকে সে নিদের্শনাও ছাত্রলীগ দিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতির মুখোশের আড়ালে ক্ষমতা, সম্পদ, টাকা পয়সা, তদবির বাণিজ্যই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়ের ছাত্র রাজনীতিতে। বিগত সরকারের ১৫ বছরের শাসন আমলে ছাত্রলীগ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে অত্যাচার করেছে তার জন্য তাদের সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিসি, প্রো ভিসি, প্রক্টরসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।
তিনি বলেন, কখনো ভাবি ছাত্র রাজনীতি না থাকলেই হয়তো ভালো হয়। আবার ভাবি এই ছাত্ররাই তো ৫২, ৬৯, ৭০, ৭১, ৯০সহ সকল আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে আমাদের অধিকার আদায় করেছে। জুলাই বিপ্লবে হাজারেরও বেশি ছাত্র-জনতা শহীদ হয়ে দেশে নতুন স্বাধীনতার জন্ম দিয়েছে। চোখ হারিয়ে, পঙ্গুত্ব বরণ করে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। সর্বশেষ যে বিপ্লবের মধ্যদিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে তার অগ্রভাগে ছিল আমাদের ছাত্ররা। তাহলে কেন আমরা ছাত্র রাজনীতির পক্ষে থাকব না।
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে ১০ দফা সুপারিশ করেছেন।
১০ দফা সুপারিশ-
১) উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
২) শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার না বানানো
৩) লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র সংগঠন বা দলীয় পরিচয়ের পরিবর্তে ব্যক্তি পর্যায়ে অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচন করা
৪) রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি ডাকসু নির্বাচনসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্টুডেন্ট কেবিনেট নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা
৫) বিগত শাসন আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, যৌন হয়রানি, নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিচার দ্রুততম সময়ে করার লক্ষ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অনিয়মে যুক্ত প্রশাসনের প্রশ্রয় দাতাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজন অনুযায়ী বর্তমান প্রশাসনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা
৬) বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাদা-লাল-নীল-বেগুনী ইত্যাদি নামকরণের মাধ্যমে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা
৭) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং, টর্চার সেল, হল দখল, সিট দখল, আদিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস দমনে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হওয়া
৮) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সকল মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের হলে সহাবস্থান নিশ্চিত কর
৯) শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার পরিবর্তে যোগ্য মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসার সুযোগ তৈরি করে দেয়া
১০) আসন্ন বাজেটে উচ্চ শিক্ষা প্রদানকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য গবেষণা, বৃত্তি ও কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে “ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের অন্তরায়” শীর্ষক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকদের পরাজিত করে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়।
প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, জোসিন্তা জিনিয়া, সাংবাদিক সৈয়দ আব্দুল মুহিত, সাংবাদিক শারমিন নাহার নীরা ও জাফর ইকবাল। প্রতিযোগিতা শেষে চ্যাম্পিয়ন দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত