সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

স্বাধীনতা, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র

হাসনাত আবদুল হাই

স্বাধীনতা, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র

টকশোতে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি রয়েছেন, অভিজ্ঞতারও অভাব নেই তাদের। কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তারা যেমন যুক্তির আশ্রয় নেন একই সঙ্গে আবেদন রাখেন বিবেক-বিবেচনার কাছে। তাদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত, এ কারণে তারা যা বলেন তার মধ্যে কমবেশি পক্ষপাত থাকে। বিভিন্ন দলের দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য এদের বক্তব্য বেশ কাজে লাগে। যদি টক শো অতিথিদের মধ্যে নিরপেক্ষ কেউ থাকেন তাহলে মাঝখানের বক্তব্যও শোনার সুযোগ ঘটে। শিক্ষিতদের মধ্যে জনমত সৃষ্টিতে টক শোর যে একটা ভূমিকা রয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

বেশ কিছুদিন থেকে বিষয় হিসেবে টক শোতে রাজনীতিই প্রাধান্য পাচ্ছে। এর কারণ রাজনৈতিক যে সংকটে জাতি নিপতিত হয়ে বিচলিত, বিমূঢ় এবং বিপর্যস্ত হচ্ছে তার ভয়াবহতা। এ বিষয়ে কিছুদিন বলার পর টক শোর বক্তারা প্রায় একই কথা বলে যাচ্ছেন, নতুন কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছেন না বলে মনে হয়। অবস্থা যখন এমন একঘেয়েমিতে পর্যবসিত হয়েছে, সে সময় হঠাৎ একদিন নতুন একটা বক্তব্য কানে এলো। বক্তা বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন অর্থাৎ অন্যদের তুলনায়, পেশায় তিনি সাংবাদিক। পুরনো কথা শুনতে হবে মনে করে কিছুটা অমনোযোগী হয়েছিলাম। হঠাৎ কানে এলো নবীন বক্তা বলছেন, স্বাধীনতা আমাদের একটা ভূখণ্ড দিয়েছে কিন্তু রাজনীতির জন্য রাষ্ট্রকে আমরা ঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারিনি। তার কথা শুনেই বাকিটা শোনার জন্য সচেতন হলাম। কিন্তু হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় তার বক্তব্যের বাকিটুকু শোনা হলো না। যেটুকু শুনলাম তার ভিত্তিতেই নড়ে-চড়ে বসতে হলো। তার কথায় খুব নতুনত্ব না থাকলেও যেভাবে সরাসরি বলা হলো তার মধ্যে ব্যতিক্রমী ভঙ্গি রয়েছে। বেশ বৃহৎ প্রেক্ষাপট থেকে তিনি বিষয়টা দেখছেন বলে মনে হলো। তিনি তার বক্তব্য বিশদভাবে নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো করে বলেছেন যা আমি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য শুনতে পাইনি। না শুনলেও নিজে মনে মনে চিন্তা করতে থাকলাম তিনি সূচনা বক্তব্যের পর নিজের কথা এবং চিন্তা এরপর কিভাবে উপস্থাপন করেছেন। দু'জন মানুষের চিন্তা এক বিষয়ে হলেও হুবহু এক হয় না, তাই আমার চিন্তা তার মতো হবে এমন আশা করি না। তবু তার চিন্তার আলোকে বিষয়টাকে কিভাবে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা যায় সেই চেষ্টা থাকবে এই লেখার পরবর্তী অংশে।

স্বাধীনতা আমাদের একটি ভূখণ্ড উপহার দিয়েছে যেখানে আমাদের সার্বভৌমত্ব রয়েছে। এই স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, কোটি মানুষের স্বার্থত্যাগে এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাই ও বোনদের সাহসিকতার মাধ্যমে। কেবল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখণ্ড এবং পতাকা পাওয়ার জন্য স্বাধীনতার যুদ্ধ করেনি বাংলাদেশের মানুষ। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি দেশ যেখানে ন্যায়বিচার থাকবে, সব শ্রেণী ও ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে সমতা-সহমর্মিতার সম্পর্ক থাকবে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এসব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলে স্বাধীন বাংলাদেশ 'সোনার বাংলা' হিসেবে আবিভর্ূত হবে, এমন আশা ছিল এ দেশের আপামর মানুষের। স্বাধীনতা তাদের মনে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশের স্বাধীন ভূখণ্ডে।

স্বাধীনতা একটা জাতির মনে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশাবাদ সৃষ্টি করে। স্বাধীনতা সেই ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তার চারদিকে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে উৎসাহ দেয়। ভবিষ্যৎ নির্মাণের কাজ রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন পেশার মানুষের। স্বাধীনতা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা ও কর্মপরিধি নির্ধারণে মতাদর্শের মতো উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকা পালন করে একটা পটভূমি হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আইনের ভিত্তিতে গড়ে তোলার দায়িত্ব অর্পিত হয় রাজনীতিবিদদের ওপর। তারা সরকারে থেকে এবং বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিষ্ঠা করেন এবং দৈনন্দিনের ভিত্তিতে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করেন। রাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে এবং তার ভবিষ্যৎ নির্মাণ কোন পথে অগ্রসর হবে। অপরদিকে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর রূপরেখা ও কর্মক্ষমতা গড়ে ওঠে নীতি-নির্ধারকদের দ্বারা, যারা তাদের অংশগ্রহণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাস্তব রূপ দেন। নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছেন রাজনীতিবিদ যারা সরকার গঠন ও পরিচালনা করেন এবং বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেন। এদের পরেই রয়েছেন আমলা শ্রেণী, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং পেশাজীবীরা, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্মতৎপরতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিকাশ ঘটান। রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী এলাকায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন বলে এই ক্ষেত্রে তাদের কি উদ্দেশ্য সেই বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যদি তাদের উদ্দেশ্য হয় জনস্বার্থের উন্নতি তাহলে তাদের সিদ্ধান্তগুলো হবে এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। অপরদিকে তাদের উদ্দেশ্য যদি হয় ক্ষমতা গ্রহণ এবং তার ব্যবহার তাহলে জনস্বার্থ ততটা রক্ষা পাবে না। ক্ষমতা অর্জনের জন্য যে রাজনীতি তা পরিচালিত হবে ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই। এর ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা খুব সংকীর্ণ গণ্ডিতে ব্যবহৃত হবে। এতে করে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো জনস্বার্থে পরিচালিত ও ব্যবহৃত না হয়ে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতালিপ্সা চরিতার্থের জন্য ব্যবহৃত হবে। এর ফলে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে পারবে না, সেখানে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেবে। তাদের কার্যক্রম যেমন বৃহত্তর স্বার্থে পরিচালিত হওয়ার কথা তার পরিবর্তে ব্যবহৃত হবে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর স্বার্থ পূরণে। একপর্যায়ে এসে দেখা যাবে যে রাজনীতি শুধু ক্ষমতা লাভের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে না, রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণকারী অন্য শ্রেণীর (যেমন, আমলা) আর্থিক অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো তখন জনস্বার্থ রক্ষা ও জনসেবার উদ্দেশ্য থেকে আরও দূরে সরে যাবে। ফলে ব্যর্থ রাষ্ট্র না হলেও দুর্বল রাষ্ট্রের উদ্ভব হবে।

বাংলাদেশের প্রথমে জনসেবার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরের পর্বে এসে দেখা যায় ক্ষমতা লাভের জন্যই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। এই উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে দেওয়া হয়েছে এবং সে সবের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। সে সময় জনস্বার্থের নাম করা হলেও প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার রাজনীতিই প্রাধান্য পেয়েছে। এটা হয়েছে বেসামরিক এবং সামরিক, উভয় শাসনকালেই। আশির দশক থেকে ক্ষমতার রাজনীতির পাশাপাশি স্থান অধিকার করেছে স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতি। জনসেবা থেকে সরে এসে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতিবিদ ও আমলাদের স্বার্থসিদ্ধির উপায় ও মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। এভাবে পরিচালিত হয়ে রাষ্ট্রের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো জনসেবার উদ্দেশ্য থেকে ক্রমে আরও দূরে সরে যায়। বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের ক্ষমতা ব্যবহারের এমন সুযোগ স্বাধীনতার আগে ছিল না। স্বাধীনতা লাভের পরই তারা নিজেদের সংকীর্ণ উদ্দেশ্য সাধনের পরিবেশ ও সুযোগ পেয়েছে। অথচ স্বাধীনতা তাদের বৃহত্তর জনসেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির মধ্যে গোষ্ঠী নয় সামষ্টিকের কল্যাণ বৃদ্ধি ছিল সবার ওপরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মঙ্গলের রাজপথ থেকে হরণ করে সরিয়ে এনে সংকীর্ণ চোরাগলিতে রেখে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে দুর্বল রাষ্ট্র আরও দুর্বল হয়ে গেছে। বর্তমানে নির্বাচন নিয়ে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলেরা মধ্যে যে সংঘর্ষ ও সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক তার মধ্যে সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে। জনগণের কল্যাণের জন্য রাজনীতি নিবেদিত করার জন্য স্বাধীনতার আহ্বান ও প্রতিশ্রুতি মুষ্টিমেয়র স্বার্থপরতায় অন্ধকার চোরাগলিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের এটাই ট্র্যাজেডি।

টক শোর বক্তা যে কথা বলতে চেয়েছেন তার সারমর্ম হলো স্বাধীন একটি ভূখণ্ড পেলেও বাংলাদেশিরা তাদের কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য অনুকূল রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও কর্মকাণ্ডের দেখা পায়নি। এর পেছনে একটাই কারণ, নষ্ট রাজনীতি। রাষ্ট্রনীতি নষ্ট হয়েছে কিন্তু পচে যায়নি এখনো। সচেতন হলে এখনো সময় আছে এই রাজনীতিকে উদ্ধার করার এবং তার স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার। রাজনীতিবিদরা যদি এক্ষেত্রে এগিয়ে না আসেন, তাহলে জনগণকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শুধু রাজনীতিবিদরা সংগ্রাম করেননি, সেখানে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল প্রধান। স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতির আলোকে রাষ্ট্রকে গড়ে তোলার জন্য আবার জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। * লেখক : কথাশিল্পী ও সাবেক সচিব

 

 

সর্বশেষ খবর