সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

কিংবদন্তি রবিশঙ্কর ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী

কিংবদন্তি রবিশঙ্কর ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

বিশ্ব বিশ্রুত সেতারবাদক ও উপমহাদেশের এ যুগের পুরোধা ব্যক্তিত্ব পণ্ডিত রবিশঙ্কর ১১ ডিসেম্বর ২০১২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট ডিয়েগো শহরের এক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। বেঁচে থাকতেই কিংবদন্তিতে পরিণত এই সুরসাধক তার সুরের জাদুতে কয়েক প্রজন্মের মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন। তার আশ্চর্য ক্ষমতাবলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন এক অপূর্ব সেতুবন্ধন।

রবিশঙ্করের পারিবারিক আদি নিবাস বাংলাদেশের নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলায়। তার বাবা শ্যামশঙ্কর একজন খ্যাতনামা ব্যারিস্টার ছিলেন। পেশাগত কারণে তিনি তদানীন্তন ভারতবর্ষ ও বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন। উত্তর প্রদেশের ভারানাসী শহরে ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল রবিশঙ্করের জন্ম হয়। তার বড় ভাই উদয়শঙ্কর বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ছিলেন। মা হেমাঙ্গনী দেবী ও ছোট দুই ভাই দেবেন্দ্র ও রাজেন্দ্রসহ রবিশঙ্কর ১০ বছর বয়সে প্যারিস গেলেন। তখন তার বড় ভাই উদয়শঙ্কর ও বাবা শ্যামশঙ্কর সেখানে কর্মরত ছিলেন। নৃত্যশিল্পী হিসেবে শুরু করলেও পরবর্তীতে রবিবাবু হয়ে গেলেন সেতার শিল্পী। অত্যন্ত তরুণ বয়সেই তিনি তার বড় ভাইয়ের দলের মূল সেতার শিল্পী হলেন। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলেন সাফল্যের উচ্চতম শিখরে।

দেশে-বিদেশে সারা জীবন কাটালেও রবিবাবু নিজকে 'যশহুরে' বলে দাবি করতেন। কারণ নড়াইল তখন যশোর জেলার একটা মহকুমা ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় রবিশঙ্কর বাংলাদেশি শরণার্থীদের বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে দেখেছেন ও নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে একাত্দা প্রকাশ করেছেন। রবি বাবুর ভাষায়, 'আমি বাঙালি। অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে, আমি প্রত্যক্ষভাবে সেখানকার পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছি।' ভারতে আশ্রিত আমাদের অগণিত শরণার্থীর মধ্যে তিনি পেয়েছেন 'আমার দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি, আত্দীয়, মুসলমান বন্ধুসহ বহু ঘনিষ্ঠজন। এমনকি আমার গুরুর (ওস্তাদ আলী আকবর খান) পরিবারের লোকজনকেও হত্যা করা হয়েছে। 'বেদনাবিদ্ধ, আবেগাপ্লুত রবিশঙ্কর ঠিক করলে মাতৃভূমির জন্য কিছু করার দরকার।

রবিশঙ্করের ডাকে সাড়া দিল পাশ্চাত্যের অনেক দেশ। তাকে একক সেতার পরিবেশনার জন্য সব ব্যবস্থা করে দিতে প্রস্তুত ছিল তারা, দিতে চেয়েছিল উচ্চ সম্মানী। কিন্তু রবি বাবু চাইছিলেন এর চেয়ে বৃহত্তর পরিসরে নিজের দেশের জন্য কিছু একটা করা দরকার যা বাংলাদেশের জন্য বয়ে নিয়ে আসবে বড় অংকের এক তহবিল ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগ করবে এক নতুন জনসচেতনামূলক অধ্যায়। তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে ও তার অনুরোধে বিশ্ববিখ্যাত বিটিলস দলনেতা জর্জ হ্যারিসন এগিয়ে এলেন। আমাদের লাখ লাখ শরণার্থীর সীমাহীন কষ্ট ও দুর্দশার কথা জেনে একটা কনসার্ট করার মনস্থ করলেন।

মাত্র চার-পাঁচ সপ্তাহের মধ্যেই তিনিই যোগাযোগ করলেন তার সহযোগীদের সঙ্গে। রেকর্ড সময়ে আয়োজিত হলো 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট বিকাল ২:৩০ ও রাত ৮টায় প্রায় ৪০-৫০ হাজার দর্শকের সামনে দুটি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হলো। রবিশঙ্করের আশা ছিল আমাদের উদ্বাস্তুদের জন্য ২৫ হাজার ডলার সংগ্রহ করার। তাৎক্ষণিকভাবেই আড়াই লাখ ডলার সংগৃহীত হয় ও তা UNICEF মারফত আমাদের সাহায্য তহবিলে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত রেকর্ড বিক্রিসহ সর্বমোট ১২ মিলিয়ন ডলার সংগৃহীত হয়েছে ও সেই অঙ্ক বাংলাদেশের সাহায্য ও পুনর্বাসন তহবিলে পাঠানো হয়েছে।

'কনসার্ট ফর বাংলাদেশের' সবচেয়ে বড় অর্জন টাকা সংগ্রহ নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। জর্জ হ্যারিসনের ভাষায়ু ‘The money we raised was secondary. The main thing was, we spread the word and helped get the war ended. What we did show was that musicians and people are more humane than politician.’ এই এক কনসার্টের ফলে পশ্চিমা জগতে ও সারা বিশ্বে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুকূলে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হলো। সমকালীন ইতিহাসে এটা একটা অসাধারণ ও অভূতপূর্ব ঘটনা। রবিশঙ্করের সঙ্গে ছিলেন তার দলের অন্যান্য সহযোগী সরোদে-ওস্তাদ আলী আকবর খান, তবলায় আল্লাহরাখা ও তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী। জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে ছিলেন রিঙ্গো স্টার, এরিখ ক্লাপট্যান, লিওন রাসেল, বিলী প্রেস্টন, ক্লাউস ভোরম্যান, জিম কেল্টনারসহ ১৮ জন।

বাংলাদেশ কনসার্টের প্রধান গান এতই মর্মস্পর্শী যে আজও তা সারা পৃথিবীতে অতি জনপ্রিয়

‘My friend came to me with sadness in his eyes,
Told me that he wanted help before his country dies,
Although I could not feel the pain I know, I had to try,
Now I am asking all of you to help us save some lives.’

আমাদের জাতির স্বাধীনতার ক্রান্তিকালে রবিশঙ্করের এই অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। রবিশঙ্করকে নিয়ে আমাদের স্বাধীনতার চার দশক পূর্তিতে আরেকটা কনসার্ট করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তা সফল হয়নি।

রবি বাবু চলে গেছেন কিন্তু তাদের আদি নিবাসটি আজও দাঁড়িয়ে আছে নড়াইল জেলার কালিয়ায়। বিশ্বজুড়ে যার এত খ্যাতি তারই বাড়িটি বর্তমানে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ভবনটি সংস্কার করে গড়া যেতে পারে তার স্মৃতি কেন্দ্র হিসেবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সংগীত সাধকরা আসবেন এখানে ও শ্রদ্ধা জানাবেন তার প্রতি। ইউরোপ ও আমেরিকায় আছে এ ধরনের অনেক স্মৃতিশালা। উচ্চ দর্শনী দিয়ে আমরা দেখতে যাই, বিভিন্ন মহারথীর আদি নিবাস।

আমরা যদি দেশের ঐতিহ্য রক্ষা না করি, তাহলে সেগুলো হারিয়ে যাবে। যেমন রবিশঙ্করের উইকিপিডিয়ার জীবনবৃত্তান্ত থেকে তার আদি নিবাস কালিয়া খসে পড়েছে। হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবেও না যে রবিশঙ্কর নাড়িসূত্রে এ দেশেরই মানুষ। বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমান তরুণদের মধ্যেই অনেকেই মনে করেন যে রবিশঙ্কর ভারতেরই লোক। বিশ্বায়নের এ যুগে নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখা খুব প্রয়োজন। তা না হলে একদিন আমাদের 'ঐতিহ্য দেউলিয়ার' গ্লানি নিয়ে বাঁচতে হবে। * লেখক : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত

 

 

সর্বশেষ খবর