শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাংলাদেশ

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের ৯ মাস বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী যে হত্যালীলা চালিয়েছে আমরা ভারতের ত্রাণশিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে তার কিছু কিছু বিবরণের কথা শুনেছি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের শেষ হলো ১৬ ডিসেম্বর। ওই দিনেই ভারতের লোকসভায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংবাদ রেডিওতে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় দেখেছি মানুষ কীভাবে পটকা ফাটিয়ে উল্লাস করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিবকে কেন্দ্র করে যে সাজ তৈরি হয়েছিল সেই সাজ গাইছিলেন তারা। হাজার হাজার নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে সেদিন পশ্চিমবঙ্গের মানুষও রাস্তায় নেমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা উদ্যাপন করেছিল। স্লোগান উঠছিল— জয় বাংলা, জয় মুজিব, জয় ইন্দিরা গান্ধী।

এতদিন যাদের দেখেছিলাম আশ্রয় নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে, তাদের দেখেছি একে অন্যকে কোলাকুলি করে স্বাধীনতার স্বাদ ভাগ করে নিচ্ছেন। মিষ্টি বিতরণ করছিলেন। যাদের সঙ্গে ৯ মাস কাজ করেছি, সেই অস্থায়ী সরকারের চার প্রধানের অফিসে যখন পৌঁছলাম, সেদিন ছিল কলকাতায় পূর্ণিমার চাঁদ। সেদিন থিয়েটার রোডে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবু হেনা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীদের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি বাইরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য নেতা তাদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভিড় ঠেলে ঢুকে দেখি ওই চার নেতা গভীর আলোচনায় মগ্ন।

তাজউদ্দীন সাহেবের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলে উঠলেন, ‘ভারতের সংসদে বিকালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে বক্তব্য রেখেছেন, আমার বক্তব্যও তাই। প্রথম কাজ হলো পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনা, আর বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা।’ সাংবাদিক নয়, মুক্তিযুদ্ধের শরিক হিসেবে আমি এক প্যাকেট সন্দেশ নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই চার নেতা ৯ মাস ধরে বহু ত্যাগ স্বীকার করে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, তা আমি সাংবাদিক হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আবু হেনা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান সন্দেশে খুশি হননি। তিনি আমাকে বলেন, ‘এসব কী? আমার জর্দা কোথায়?’ প্রসঙ্গত আমি ওনাকে মাঝে মাঝে জর্দা সাপ্লাই করতাম। আমি বললাম, জর্দা কাল পাবেন, এখন প্রতিক্রিয়া দিন। উনি বললেন, ‘এখন একটাই কাজ— বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলা, বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে এনে নতুন বাংলা তৈরি করা।’ রাত তখন ৯টা। কলকাতার রাস্তায় ঝলকাচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ। পাড়ায় পাড়ায় রেকর্ডে বাজছে ‘আমার সোনার বাংলা’। তিনি আরও বললেন, ‘ইন্দিরা গান্ধীর মাধ্যমে ভারতের প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং মানুষের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তা খুবই বিরল একটা অভিজ্ঞতা।’

থিয়েটার রোড থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তার দুই ধারে মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছে। আমার একটা আক্ষেপ থেকে গেছে। তা আজ উল্লেখ করছি। ৯ মাস আমি ১৮ ঘণ্টা কাজ করেছি। কিন্তু ১৬ তারিখ বিকালে ঢাকার রমনা ময়দানে নিয়াজি-ইয়াহিয়া-ভুট্টো বাহিনী  আত্মসমর্পণ করল, সেখানে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। এটা আমার দুর্ভাগ্য বলা যায়। কারণ ফোর্ট উইলিয়াম থেকে আমার এবং আরেক প্রধান সাংবাদিকের যাওয়ার কথা ছিল হেলিকপ্টারে। আমরা সারা দিন ধরে দেখলাম, এক এক করে বিদেশি সাংবাদিককে নিয়ে যাওয়া হলো। বিকাল বেলা আমরা চেপে ধরতে তারা বললেন, এখন বিকাল হয়ে গেছে। আর হেলিকপ্টার উড়বে না। অর্থাৎ আমাদের আর ঢাকা যাওয়া হলো না।

অফিসে ফিরে আসতে সম্পাদক বললেন, ‘কেমন দেখলেন।’ তাকে ওপরের ঘটনাটা খুলে বললাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দিল্লিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী তার বাল্যবন্ধু বাবু জগজীবন রামকে ফোন করে পুরো ঘটনা জানিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। জগজীবন তাকে শান্ত করে বলেন, পরদিনই একটি হেলিকপ্টার আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসবে। আমি ১৮ তারিখ আবার ঢাকায় এসেছিলাম। ১৭ তারিখে কলকাতার আশপাশে যেসব আশ্রয়শিবির ছিল, সেখান থেকে হাজার হাজার লোক রাস্তায় বেরিয়ে স্বাধীনতা উদ্যাপন করেন। বেশকিছু লোক মিষ্টি হাতে করে আমাদের অফিসের সামনে এসে হাজির হয়। আমি ১৮ তারিখে ঢাকার হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে উঠেছিলাম। সেই হোটেলের সামনে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমাদের হাতে এক গ্লাস করে গরম দুধ তুলে দিয়েছিলেন।

হঠাৎ দেখি এক মাঝবয়সী মহিলা আমার দিকে আসছেন। আমার গাল ধরে বললেন, ‘তুমি কলকাতা থেকে এসেছ? তুমি আমার স্বামী আর বড় ছেলেকে দেখেছ?’ আমি তাকে হাত ধরে লবিতে এনে বসালাম। মহিলার পরিচয় পেলাম। তার নাম জাহানারা ইমাম। পরবর্তীকালে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। আমার দিদির মতো হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর যতবার কলকাতায় গেছেন, আমার বাড়িতেই উঠতেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদে। বিয়ের পর ঢাকায় এসেছি।’

৪৫ বছর পর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ চারজনের নাম আগেই উল্লেখ করেছি। এবার তাদের হত্যার বিষয়টি বলছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার কিছুদিন পরেই এদের প্রথমে গৃহবন্দী ও পরে গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই চারটি নাম চিরদিন থাকবে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী আমেরিকা ও পাকিস্তান মনে করেছিল, এরা যদি আবার পালিয়ে ভারতে ঢুকতে পারে, তাহলে দ্বিতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হতে পারে। এই আশঙ্কায় কলকাতায় আমেরিকান কনস্যুলেটে বসে তারা ওই চারজনকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এ খবর আমরা পাই ভারতের গোয়েন্দা সূত্রে। এই ষড়যন্ত্রের নায়ক জিয়ার সহযোগী মেজর ডালিম জেলের ভিতর তাদের হত্যা করে রেডিও মারফত ঘোষণা করেন ‘বাংলাদেশ এবার মুক্ত।’ এর পরেই তিনি থাইল্যান্ড হয়ে আমেরিকায় চলে যান। কে এই ডালিম?

এপ্রিল মাসে কলকাতায় গিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনে প্রথম সচিব আর চৌধুরীর মেয়েকে বিয়ে করেন। মুক্তিযুদ্ধে যখন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, সে সময় কলকাতার একটি হোটেলে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর তত্ত্বাবধানে একটি হোটেলে বিয়ের অনুষ্ঠান করেন। বিয়ের পর ১৬ ডিসেম্বরের বহু আগে শ্বশুরের সঙ্গে বম্বে হয়ে পাকিস্তানে চলে যান।

ওই চার জাতীয় নেতার হত্যার পরদিনই ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্মসচিব শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আপনার বন্ধু কামারুজ্জামানের দুই ছেলে নরেন্দ্রপুরের স্কুলে পড়ে। ওদের আপনার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখুন। কারণ ঘাতকরা নরেন্দ্রপুরেও ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ তিনি দুই পুত্র লিটন আর স্বপনকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসেন। ওদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যোগাযোগ হয়নি। সাত-আট বছর আগে দিল্লি বিমানবন্দরে স্বপনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আর এই লেখার আগের দিন রাজশাহীতে থাকা লিটনের সঙ্গে কথা হলো টেলিফোনে।

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীন হলেও ষড়যন্ত্র এখনো চলছে।’ তিনি ঠিকই বলেছিলেন, বিদেশি শক্তিরা এখনো বাংলাদেশকে ধ্বংস করার ব্যাপারে সক্রিয়। শেখ হাসিনা এখন সেই বিদেশি শক্তি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর সঙ্গে লড়াই করছেন। যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তার বাবা বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন সেই মানুষগুলোর আজ শেখ হাসিনার লড়াইয়ের সঙ্গেও থাকা উচিত। বরিশালের কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন— ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি।’ আর আমি দেখেছি বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই ১৬ ডিসেম্বর এলেই পুরনো কথাগুলো ভিড় করে আসতে থাকে।

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর