শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সীমা ও তার প্রয়োগ

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সীমা ও তার প্রয়োগ

বছর চারেক আগের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী, সম্ভবত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অথবা সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী, আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, আমার তখনকার কয়েকটি লেখা পড়ে তাঁর মনে হয়েছে, আমি অবাধ ও পূর্ণ বাকস্বাধীনতা ও নাগরিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নই। আমি তাঁকে ব্যক্তিগত জবাব দিয়েছি এবং তাঁর চিঠির প্রসঙ্গ টেনে আজকের এই লেখা।

আমি তাঁকে লিখেছিলাম, অবাধ স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। সুস্থ দায়বদ্ধতা থেকেই ব্যক্তিস্বাধীনতা, সামাজিক স্বাধীনতা, এমনকি সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও পূর্ণতা পায়। বার্নার্ড শ ও এইচ জি ওয়েলসের একটি কথোপকথন আমার খুব প্রিয়। বহুকাল আগে নাগরিক স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আমার লেখায় (অধুনালুপ্ত বাংলার বাণীতে প্রকাশিত) সেটি উল্লেখ করায় প্রয়াত কথাশিল্পী শওকত ওসমান আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কথোপকথনটি আবারও লিখছি।

লন্ডনে টেমস নদীর পাড়ে বার্নার্ড শ একদিন মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন। উল্টো দিক থেকে এইচ জি ওয়েলসও আসছিলেন। তাঁর হাতে একটা ছড়ি। সেটা তিনি ঘোরাচ্ছিলেন। বার্নার্ড শর কাছে এসেও তিনি ছড়ি ঘোরানো বন্ধ করলেন না। শ বললেন, ‘ছড়ি ঘোরানো থামাও। ওটা তো আমার নাকে আঘাত করতে যাচ্ছে।’ ওয়েলস বললেন, ‘আমি এ দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক। যেখানে খুশি সেখানে ছড়ি ঘোরানোর নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার আমার আছে।’ বার্নার্ড শ বললেন, ‘অবশ্যই সে অধিকার তোমার আছে। কিন্তু আমার নাকের ডগা যেখানে শেষ, সেখান থেকে তোমার নাগরিক অধিকারের শুরু।’

বার্নার্ড শর এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, একজন নাগরিকের স্বাধীনতারও একটা সীমা ও দায়বদ্ধতা আছে। সেটা অন্য নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা সম্পর্কে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে যখন বাকস্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব করে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, তখন কয়েকজন সম্পাদক বার্টান্ড রাসেলকে এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। রাসেল বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব আমার কাছে এখন বেশি বিবেচ্য। নাগরিক স্বাধীনতা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এই মুহূর্তে আমার কাছে বেশি বিবেচ্য নয়।’

রাসেলের এই কথা থেকেও বোঝা যায়, অবাধ ও পূর্ণ স্বাধীনতা কথাটিরও একটা প্রেক্ষাপট ও দায়বদ্ধতা আছে। রাষ্ট্র বা সরকার যখন তার নাগরিককে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়, তখনই রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের একটি অলিখিত দায়বদ্ধতা জন্মায়। রাষ্ট্র বা সরকার অত্যাচারী হলে, অন্যায়ভাবে নাগরিক স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা হরণ করতে চাইলে অবশ্যই নাগরিকরা প্রতিবাদ জানাবেন, বিদ্রোহী হবেন। কিন্তু রাষ্ট্র বা সরকার যখন রাষ্ট্রের বা জনগণের স্বার্থ, স্বাধিকার ও নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতা জরুরি সময়ের জন্য আংশিক বা পূর্ণভাবে স্থগিত রাখে, তখন সেই ব্যবস্থাকে নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করা বলা চলে না।

জাতীয় স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরস্পরের পরিপূরক। একের অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা। নাগরিকদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও জাতির আপৎকালে ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রয়োজনে কিছু খর্ব করে হলেও রাষ্ট্রের ও জাতির অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা করা। একমাত্র ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রে সরকার ও জনগণের মধ্যে এই দায়বদ্ধতা থাকে না। রাষ্ট্র এখানে নাগরিক স্বাধীনতা হরণকারী ও নির্যাতনকারী এবং জনগণ তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার ছিনিয়ে আনার জন্য ওই স্বৈরাচারী ব্যবস্থার উত্খাতকামী।

প্রেস ফ্রিডম ও সিভিল লিবার্টি সম্পর্কে কিছুকাল আগে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এক বক্তা রাষ্ট্র বা সরকারের কোন হস্তক্ষেপ নাগরিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনকারী বলে বিবেচিত হতে পারে, সে সম্পর্কে একটি তুলনা টেনেছিলেন। তুলনাটি একটু অশ্লীল। এখানে সেটি উল্লেখ করছি। আশা করি, আমার পাঠকরা ক্ষমা করবেন। সেমিনারের বক্তা বলেছিলেন, ‘রেপ বা ধর্ষণ এবং লাভ মেকিং বা সহবাস একই কাজ। কিন্তু দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর পারস্পরিক সম্মতিতে যখন কাজটি হয় তখন তা অত্যাচার নয়, বরং ভালোবাসা। কিন্তু নর ও নারীর কোনো একজনের সম্মতি ছাড়া জোরপূর্বক যে কাজটি করা হয় তা রেপ বা ধর্ষণ- অর্থাৎ অত্যাচার। ধর্ষণকারীকে সাজা দিতে হয়।’ এই গল্পটি বলে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, রাষ্ট্রের বা জনগণের স্বার্থে সরকার কোনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা অধিকার হরণ নয়। কিন্তু দেশ বা জনগণের স্বার্থে নয়, নিজেদের ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য জনগণের সম্মতি নিয়ে নয়, বরং তাদের কণ্ঠ রোধ করার জন্য কোনো সরকার যখন ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তখন তা নির্যাতন এবং নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ। তখন নাগরিকদের দায়িত্ব এই অধিকার হরণের প্রতিবাদ করা এবং সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।

পাকিস্তান আমলে আইয়ুব সরকার যখন তথাকথিত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অর্ডিন্যান্স করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করেছিল, তখন পাকিস্তানের উভয় অংশের সংবাদপত্র মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিকরা একযোগে প্রতিবাদ মিছিলসহ রাজপথে নেমেছিলেন। আমার মনে আছে, সে সময় ঢাকার প্রেসক্লাব থেকে সম্পাদক ও সাংবাদিকরা বিরাট প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিলেন। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন তখনকার তিন বিখ্যাত সম্পাদক—তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী ও আবদুস সালাম। এমনকি বয়সের ভারে ন্যুব্জ মওলানা আকরম খাঁ সাংবাদিক এ বি এম মূসার ছাদখোলা একটি ছোঁ গাড়িতে দাঁড়িয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই যখন জামায়াতি কাগজ দৈনিক সংগ্রাম, সাপ্তাহিক ‘জাহানে নও’, নেজামে ইসলামের কাগজ দৈনিক ‘নাজাত’ বা আরও একটি মৌলবাদী কাগজ ‘আজান’ বন্ধ হয়ে যায় বা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন কেউ বলেননি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এই পত্রিকাগুলোতে ভিন্নমত প্রচার নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িক উসকানি প্রদান ও হানাদারদের প্রচারণায় সহায়তাদানের অভিযোগ ছিল। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা), অবজারভার, এমনকি দৈনিক সংবাদের দীর্ঘকালের সম্পাদকদের বিদায় দিয়ে নতুন সম্পাদক বসানো হয়। তখন কেউ বলেননি, তাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে এবং কোলাবরেটর কাগজগুলো বন্ধ হতে দেওয়া উচিত হয়নি। কারণ তাতে বহু সাংবাদিক কর্মচ্যুত হয়েছেন।

বাংলাদেশ এখন এক জাতীয় সংকটকাল অতিক্রম করছে। তার স্বাধীনতার মূল ভিত্তিগুলো শুধু নয়, তার গণতান্ত্রিক অস্তিত্ব পর্যন্ত আজ চ্যালেঞ্জ ও চক্রান্তের সম্মুখীন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহমূলক তত্পরতা পর্যন্ত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মুখোশের আড়ালে চালানো হচ্ছে। এ সময় নিরপেক্ষ সাংবাদিক সাজার অবকাশ কোথায়? এ সময় আমাদের কাছে জাতীয় স্বাধীনতা বড়, না জাতীয় স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে তত্পরতা চলছে, তাকে নাগরিক স্বাধীনতা ভেবে সমর্থদান বড়?

প্রকৃত সাংবাদিকতা ও অপসাংবাদিকতা এবং প্রকৃত সম্পাদক ও নকল সম্পাদকের মধ্যে পার্থক্যটি আমাদের আজ ভালোভাবে বোঝা উচিত। চোর যেমন সাধু সাজলে তাকে সাধুর মর্যাদা দেওয়া উচিত নয়; তেমনি কেউ তার অপরাধ ঢাকার জন্য সাংবাদিকতার পবিত্র পেশার মুখোশ ধারণ করলে তার মুখোশ উন্মোচন করা উচিত, সম্পাদকের বা সাংবাদিকের মর্যাদা দেওয়া উচিত নয়। কোনো অপরাধী সাংবাদিক সেজে তার বা তাদের অসাধু তত্পরতা চালাতে চাইলে তাকে সম্পাদক বা সাংবাদিক হিসেবে মেনে নেওয়া আমি আমার সাংবাদিক পরিচয়ের অমর্যাদা মনে করি।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর