রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের বিজয়গাথা

ড. আতিউর রহমান

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের বিজয়গাথা

২৬ মার্চ, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে।’ এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা ছিল তাঁর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য। সে কারণে আমরা ছোটবেলা থেকেই তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে এটি প্রতিধ্বনিত হতে দেখতে পাই। যেখানে গিয়েছেন সেখানেই উদাত্ত কণ্ঠে তিনি মানুষের উন্নয়নে কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনে সর্বাগ্রে থেকেছে এ দেশের সাধারণ মানুষ। পাকিস্তানের সাংবিধানিক সংসদেও তিনি বারে বারে পূর্ব বাংলার কৃষক ও গরিব মানুষের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। আর তাঁর ছয় দফা তো ছিল বাঙালির প্রাণের দাবি। তাঁর মুক্তির ডাকে সাড়া দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ বন্দীদশা থেকে লন্ডন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে তিনি যাত্রাবিরতি করেন। সেখানেই উচ্চারণ করেন, ‘অবশেষে আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। ... আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার যে বিরাট কাজ এখন আমাদের সামনে, তাতে যোগ দেওয়ার জন্য আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে। (টাইমস অব ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২)।’ আর দেশের মাটি স্পর্শ করেই তিনি ছুটে যান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাঁর প্রিয় জনমানুষের কাছে। সেদিন তিনি মাটি ও মানুষকে পুঁজি করে সবার জন্য শান্তির দেশ গড়ার অঙ্গীকার করেন। সেই অঙ্গীকারের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ২৬ মার্চ, ১৯৭২ জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া তাঁর ভাষণে। সেদিনও তিনি উচ্চারণ করেন, “আমি ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।” সেই প্রতিশ্রুতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি দেশের অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, একটি আদর্শ সংবিধান রচনা, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ইউজিসিসহ নানা প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তোলা, অর্থনীতির চাকাকে ফের চালু করা, খাদ্য সাহায্য ও উৎপাদন নিশ্চিত করাসহ নানামুখী কর্মতৎপরতায় নিজেকে সর্বক্ষণ নিয়োজিত রেখেছিলেন। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে তিনি একের পর এক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। আর এসব কিছু তিনি করছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির আলোকে। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় শোষণমুক্ত, সমাজতান্ত্রিক এক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে নাগরিকদের মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করা হবে। তা ছাড়া ধারা ১০-এ মানুষে মানুষে শোষণ নিরসন, ধারা ১৩-এ রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী এবং ব্যক্তি মালিকানায় সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থা করা, ধারা ১৪-এ খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক ও পিছিয়ে পড়া জনগণের শোষণ থেকে মুক্ত করা এবং ১৫ ধারা-এ পরিকল্পিত উপায়ে রাষ্ট্র উৎপাদনশীল শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে নাগরিকদের জীবনের মান উন্নত করে খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

আরও বলা হয়েছে কাজের অধিকার, নিশ্চিত কর্মসংস্থান ও মজুরির ব্যবস্থাও করবে রাষ্ট্র। সংবিধানের এসব অঙ্গীকার বাংলাদেশের উন্নয়নের মূলভাবনায় যুক্ত হয়েছে বলেই আমরা একই সঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধিশীল অথচ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের এক নয়া ধারা আজও অব্যাহত রাখতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর ১০টি সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশের একটি। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে তার অবস্থান ৩৪তম। জেন্ডার সাম্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সাফল্য। স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যেই দেশ পুনর্গঠনে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ, পুরো দেশবাসীকে এ কাজে উজ্জীবিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া পদক্ষেপগুলো আশাতীত সাফল্য অর্জন করে।

বঙ্গবন্ধু সারা জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। তাঁর শোষণহীন সমাজ গঠনের স্বপ্নের জমিনের বড় অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশের কৃষক। কৃষকদের সন্তানরাই যে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ। গরিবহিতৈষী বঙ্গবন্ধু সে জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কৃষকদের দিকে নজর দেন। তিনি সব সময় বলতেন, ‘আমার দেশের কৃষকেরা সবচাইতে নির্যাতিত।’ কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য তিনি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিকসহ মেহনতী মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। পঞ্চাশের দশকে তাঁকে দেখেছি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষকের পক্ষে কথা বলতে, ষাটের দশকে দেখেছি ছয় দফার আন্দোলনে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সোচ্চার হতে। আর স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখেছি সর্বক্ষণ কৃষক-অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধুকে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ তারিখের ভাষণেও এ দেশের কৃষক-সমাজের অধিকার সংরক্ষণের কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে কৃষকদের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর ১০ বছর পর বাংলাদেশের কাউকে জমির খাজনা দিতে হবে না।’ সে কথা তিনি রেখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি-অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, কৃষি-যন্ত্রপাতি সরবরাহ জরুরি ভিত্তিতে বিনামূল্যে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য ধানবীজ, পাটবীজ ও গমবীজ সরবরাহ করা হয়। দখলদার পাকিস্তানি শাসনকালে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেওয়া হয় ও তাদের সব বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেওয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করা হয়। ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। গরিব কৃষকদের বাঁচানোর স্বার্থে সুবিধাজনক মূল্যের রেশন সুবিধা তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য নিবারণের তাগিদে কৃষি-উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তখন ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ। ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণযোগ্য খাস জমির সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য বঙ্গবন্ধু পরিবারপিছু জমির সিলিং ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের খাদ্যঘাটতি ছিল প্রাথমিক হিসেবে ৩০ লাখ টন। তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের সংগ্রামে নেমে পড়েন তিনি।

বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টনের ফর্মুলা নির্ধারণে অত্যন্ত জোরদার উদ্যোগ নেন। ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানির ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি তিনি আদায় করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লাখ একরে উন্নীত হয়। গঙ্গা নদীর প্রবাহ থেকে অধিক পানি প্রাপ্তি, সেচ ব্যবস্থার প্রসার, ভর্তুকি দিয়ে অধিক হারে উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত খাস জমি প্রাপ্তি এবং মূল্য সমর্থনমূলক সচেতন ও কৃষকদরদি নীতির ফলে কৃষি ক্ষেত্রে অগ্রগতির যে ধারা সূচিত হয়েছিল তারই ফলে আজ কৃষিক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা বজায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই ধারাকে আরও বেগবান করেছেন।

কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, বিশেষ করে অধিক ফসল উৎপাদন, সেই সঙ্গে উৎপাদিত কৃষিপণ্য কৃষকরা যাতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারেন সেদিকে বঙ্গবন্ধুর সুদৃষ্টি ছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে কৃষি উৎপাদনের প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ খুব বেশি না থাকলেও এগুলোর প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সেচ, সার, বীজ ইত্যাদি ব্যবহারে কৃষকদের তাদের নিজেদের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে বলতেন। জেলা-গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কৃষি ও কৃষকদের প্রতি নজর দেওয়ার জন্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, কৃষিই যেহেতু এ দেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস, সেহেতু কৃষির উন্নতিই হবে দেশের উন্নতি।

৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বেতার টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরনো সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে পুরনো সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ ও অবিচারমুক্তি নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলব এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলগ্নে সম্পদের সামাজিকীকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি শুভ সূচনা হিসেবে আমার সরকার উল্লিখিত বিষয়গুলো জাতীয়করণ করেছে।

১. ব্যাংকগুলো (বিদেশি ব্যাংকের শাখাগুলো বাদে), ২. সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসহ (বিদেশি বীমা কোম্পানির শাখাগুলো বাদে), ৩. সব পাটকল, ৪. সব বস্ত্র সুতাকল, ৪. সব চিনিকল, ৫. অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌযানের বৃহদাংশ, ৬. ১৫ লাখ টাকা মূল্যের তদূর্ধ্ব সব পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি, ৭. বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে সরকারি সংস্থা হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে এবং ৮. সমগ্র বহির্বাণিজ্য রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহির্বাণিজ্যের বৃহদাংশকে এ মুহূর্তে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।’

ওই দিন তিনি আরও বলেন, ‘সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল তা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্য আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি। আজ আমরা বিশ্ব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে আমরা বিভোর, একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রুতিতে আমরা অটল, আমাদের সমস্ত নীতি আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা এ কাজে নিয়োজিত হবে। আমাদের দুস্তর পথ। এ পথ আমাদের অতিক্রম করতেই হবে।’

তবে শুরুতে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পায়নের ভিত্তি সুদৃঢ় করলেও ধীরে ধীরে তিনি ব্যক্তি খাতের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হন। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত ব্যক্তি খাতনির্ভর হলেও তাকে সহায়তার জন্য জ্বালানিসহ মেগা অবকাঠামো খাত সরকারি বিনিয়োগেই গড়ে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ঘিরেই দেশে উল্লেখ করার মতো প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হচ্ছে। অর্থনীতির এই বাড়ন্ত অবস্থা (সর্বশেষ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮৬%) বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল করেছে। নিজের অর্থে পদ্মা সেতু তৈরি করার সিদ্ধান্তছিল বঙ্গবন্ধুকন্যার এক অসাধারণ সাহসী পদক্ষেপ। এরপর থেকে উন্নয়ন অংশীদাররাও বাংলাদেশকে সমীহ করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এই সাহস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেখিয়েছিলেন দেশের অগ্রসরমান অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার (তখন আট মাসের আমদানির সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গড়ে উঠেছিল) ওপর ভর করেই। সেই সাহস তিনি আরও অনেক ক্ষেত্রেই দেখিয়ে চলেছেন। আমার বড়ই সৌভাগ্য যে, ইতিহাসের সেই বাঁক বদলের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে আমি তাঁর পাশে থাকতে পেরেছিলাম। তবে এই সাহস তিনি জম্ম  সূত্রেই পেয়েছেন। জনাব সাইদুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘১৯৭৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দাতাদের প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে বলতে পেরেছিল যে, পাকিস্তানের নেওয়া বিদেশি সাহায্যের কোনো দায় নেবে না। কেননা বাংলাদেশ পাকিস্তানের কোনো উত্তরাধিকারী রাষ্ট্র নয়। বিশ্ব ব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার কারগিল ওই সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা না নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ কী খাবে। এম সাইদুজ্জামান লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধু পাইপ হাতে নিয়ে উঠে তাকে বললেন, ‘আমার সঙ্গে আসুন’, বলে জানালার কাছে নিয়ে গেলেন, দেখালেন এবং বললেন, ‘আপনি নিচে কী দেখতে পাচ্ছেন? আপনি বাইরে কী দেখতে পাচ্ছেন? কারগিল বললেন, ‘সবুজ ঘাসের একটি সুন্দর উঠোন’। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘যদি আপনারা কোনো ধরনের সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তবে আমার জনগণ এগুলো খাবে।’ (দেখুন ‘দৈনিক বণিকবার্তা’, ৭ অক্টোবর ২০১৮) এমনি আত্মমর্যাদাশীল এক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী সময়ে অবশ্য অনেক শিথিল শর্তে ওই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল। গঠিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ এইড গ্রুপ’। আরও বেশি বিদেশি সাহায্য পেতে বাংলাদেশের সমস্যা হয়নি। ঠিক যেমনটি ঘটছে এখন শেখ হাসিনার বাংলাদেশে। বিশ্ব ব্যাংক থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণ না নেওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে এখন আরও বেশি করে অন্যান্য খাতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক, এআইআইবি, আইডিবি,  ডিএফআইডি, এডিবি, জাইকাসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই। নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা এখন তাঁর বাবার মতোই মাথা উঁচু করে বাইরের দিকে তাকান। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যে সৎসাহস তিনি দেখিয়েছেন তাতে বিদেশিদের কাছে তিনি একজন সাহসী ও মানবিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আদৃত হচ্ছেন। একই সঙ্গে অসংখ্য মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং সমাজের বঞ্চিতজনদের সামাজিক সুরক্ষার নীতি গ্রহণ করে ভারসাম্যপূর্ণ জনকল্যাণধর্মী উন্নয়নের ধারা সচল রেখেছেন।

বঙ্গবন্ধুর সেই সাহস ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের পরম্পরায় বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে দিনবদলের এক অদম্য অভিযাত্রায়।  বিজয়ের এই মাসে আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণধর্মী উন্নয়নের রূপরেখা এবং একই সঙ্গে অঙ্গীকার করছি, যে কোনো মূল্যে স্বদেশের এই অগ্রযাত্রাকে আমরা অক্ষুণ্ন ও অটুট রাখব আগামী দিনগুলোতে।

বাংলাদেশ  চিরজীবী হোক।

 

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ।

সর্বশেষ খবর