বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

একুশে এবং সমাজ-রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতা

আহমদ রফিক

একুশে এবং সমাজ-রাজনীতির বর্তমান বাস্তবতা

প্রতিবছরের মতো এ বছরও আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে মহাসমারোহে ভাষার মাস হিসেবে ফাল্গুন নয়, ফেব্রুয়ারির আবির্ভাব। কিন্তু এ স্ববিরোধিতা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলি না। বরং অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠানে একুশের মাসে ভাষিক সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটাই। এতে বাংলা একাডেমির ভূমিকা সর্বাধিক। মাসব্যাপী প্রবন্ধ পাঠের সেমিনার এবং সংগীতানুষ্ঠান। তবে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ একুশের বইমেলা। দিন যত যাচ্ছে, মেলার আয়তন বেড়ে চলেছে। লেখক-প্রকাশক-পাঠক-ক্রেতার সমন্বয়ে বইমেলার চরিত্র যতটা জ্ঞানচর্চা, সাংস্কৃতিক বিনোদন ও মননশীলতার, তারচেয়ে অনেক বেশি বিনোদনের আনুষ্ঠানিকতার। বইমেলায় আসা অনেকের কাছেই বেড়াতে এসে, বিকালটা আনন্দে কাটানো ও গান শোনার, বড়জোর পরিচিতজনের দেখা-সাক্ষাতের আনন্দ লাভের জন্য।

এটাও একেবারে গুরুত্বহীন নয় সামাজিক-সংস্কৃতির বিচারে। তবে বইমেলার প্রকৃত উদ্দেশ্য কিন্তু বই কেনা ও বই পড়ার মাধ্যমে চেতনা ঋদ্ধ করা ও আলোকিত করে তোলার সাহায্য করা। আর মাসব্যাপী গোটা অনুষ্ঠানাদির সাংস্কৃতিক তাৎপর্য কিন্তু একুশের চেতনা ও তার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য মন ও মননকে উদ্দীপ্ত করা।

এ লক্ষ্য যতটা অর্জিত হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। উঠতে পারে এমন অভিযোগও যে একুশে এখন আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত। এর দায় যতটা এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি চর্চার, তার চেয়ে বেশি শাসনযন্ত্রের। তাদের বৈদেশিক সংস্কৃতিনির্ভর শাসন ব্যবস্থার।

ঔপনিবেশিকতার অবাঞ্ছিত দায়ভার ঝেড়ে ফেলতে না পারার। দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশি শাসনে থাকা এবং ঔপনিবেশিক শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে গড়ে ওঠা শিক্ষিত শ্রেণির যে প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেছিল, তার ধারাবাহিকতা পরাধীনতামুক্ত স্বদেশি সমাজে বহন করা ও লালন করা অবাঞ্ছিত হলেও বাঙালির জীবনে সত্য হয়ে উঠেছে, হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় নির্বিশেষে। এবং তা প্রধানত শিক্ষিত শ্রেণিতে এবং শহুরে ও নাগরিক জীবনাচরণে। গ্রামীণ জীবনযাত্রা এদিক থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন।

দুই.

তবে এ কথাও সত্য যে, দুই পাকিস্তানের বৈষম্য ঘোচাতে এবং ভাষিক জাতীয়তার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা ঘটায় শিক্ষিত শ্রেণির সন্তানরা। যারা, বিশেষ করে যারা মাতৃভাষাপ্রেমী ও রাজনীতিসচেতন। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে ভাষার অধিকার থেকে জাতীয় স্বার্থের অধিকার অর্জনের যে লড়াই শুরু হয় তার পেছনে সমর্থন জুগিয়েছিল পেশাজীবী শিক্ষিত শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষ, এমনকি শ্রমজীবীদের একাংশ।

দুই দশকের এই সংগ্রাম পরিণতি পায় একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে, এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র অর্জনে। এতে ছিল ভাষিক জাতীয়তার প্রবল আবেগ-উচ্ছ্বাস, যা বলা হয়ে থাকে বাঙালির স্বভাব-বৈশিষ্ট্য। ষাট দশকের শেষার্ধে বাঙালিয়ানার আবেগধর্মী জোয়ার এক অবিশ্বাস্য ঘটনাই বলতে হয়।

ঘটনা অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর এ কারণে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে দ্রুত কয়েক বছরের মধ্যেই এর বিপরীত চেতনার প্রকাশ ঘটতে থাকে। এবং এর ব্যাপক বিস্তার পূর্বোক্ত শিক্ষিত শ্রেণির হাতে। বিশেষ করে যাদের হাতে শাসন ক্ষমতার দড়িদড়া যা আসলে রাজদণ্ড হিসেবেই বিবেচিত।

এই বিশেষ শ্রেণির শাসন ব্যবস্থার টানে সমাজে, বিশেষত শিক্ষিত সমাজে একদিকে ঔপনিবেশিক রাজভাষা সংস্কৃতির বিকাশ, অন্যদিকে সমকালীন সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব এতটা গভীর ও ব্যাপক হয়ে ওঠে যে, সেখানে পূর্বোক্ত বাঙালি সংস্কৃতির প্রকাশ দৃশ্যমান নয়। বিদেশি করপোরেট পুঁজিবাদের প্রভাবে সৃষ্ট দেশীয় করপোরেট পুঁজির সংস্কৃতি দুইয়ে মিলে সমন্বিত ধারায় বিকশিত হয়ে চলেছে।

একুশের চেতনা, একুশের সংস্কৃতি এক্ষেত্রে অনেকটাই অসহায়। বিরাজমান পরিস্থিতি নিঃশব্দে প্রতিবাদহীনভাবে দেখা ছাড়া যেন তার পক্ষে আর কিছু করার নেই। অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে লড়াই তো দূরের কথা। নব্য উপনিবেশবাদী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে লড়াই সহজ ও সম্ভব ছিল, তা এখন অবস্থাবিচারে হিসাবের বাইরে।

কারণ দেশে, সমাজে এত দ্রুত বিত্তবান ধনিক শ্রেণি, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে যে, তাদের অর্থনৈতিক-সামাজিক শক্তি অপরিসীম। কে তাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামবে, কেন নামবে? পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে সন্তানরা ভাষা প্রেমের তাগিদে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছিল, বাংলাদেশে তাদের উত্তর-প্রজন্ম এখন কেরিয়র-সন্ধানী, বিদেশমুখী।

বিদেশি সংস্কৃতি ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তাদের গভীর আকর্ষণ আর সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে। এসব নিয়ে সমাজে একটি জরিপ ও পরিসংখ্যান খুবই জরুরি, যা আমাদের সামাজিক বাস্তবতা বুঝতে সাহায্য করবে। তাতে সম্ভবত দেখা যাবে, শীর্ষ রাজনৈতিক পরিবার, উচ্চবিত্ত-বিত্তবান ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিতে এমন পরিবার কমই আছে যাদের কোনো না কোনো সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করছে না, কিংবা পড়াশোনা শেষে আর দেশে ফিরছে না।

পাকিস্তানি আমলে উচ্চশিক্ষা ও ভালো জীবিকার সুযোগ-সুবিধার অভাবে মেধাবীরা কষ্ট করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। নিজ মেধায় সেখানকার সমাজে জায়গা খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু বর্তমান অবস্থাটা একেবারে ভিন্ন। বিত্তবৈভব ও সম্পদের প্রাচুর্য এখন বিশেষ পরিবারগুলোতে বিদেশগমন এবং স্থায়ী বসবাসের প্রেরণা। সেক্ষেত্রে তারুণ্যই প্রধান।

অবশ্য সচ্ছল বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানও তার মেধানুযায়ী সুযোগ-সুবিধার অভাবে, মূলত অর্থনৈতিক সচ্ছলতার টানে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন পরিবারের তরুণ-তরুণী— কিছুটা ভালোভাবে বেঁচে থাকার বাধ্যবাধকতা থেকে। শেষোক্ত শ্রেণি অবশ্য এ জাতীয় যাত্রায় যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন। তবু তারা বেপরোয়া। কিছুকাল আগেকার সংবাদচিত্রে শরণার্থী সমস্যার বিষয়টিতে বাঙালি অভিবাসীর সংখ্যা কম ছিল না।

বাংলাদেশি সমাজের চিত্রটা এসব কারণে এতটাই পাল্টে গেছে যে, এর সঙ্গে কোনো দিক থেকে পূর্বোক্ত ছবির যেমন মিল নেই, তেমনি নেই যুক্তি ও আদর্শগত সংগতির। সমাজে নানামাত্রিক দূষণ, রাজনীতি থেকে একাধিক খাতে তার বিস্তার ভিন্ন এক বাংলাদেশের চালচিত্র তৈরি করে চলেছে। বিগত পঞ্চাশ ও ষাটের দশক যদি হয়ে থাকে যুক্তিসঙ্গত দেশাত্মবোধক সংগ্রামের কাল, সেক্ষেত্রে বর্তমান সময় ভোগবাদী ও আদর্শহীনতার কাল হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।

তিন.

কেন এমন অবাঞ্ছিত অবস্থা? এর জবাব কম-বেশি সবারই জানা। শ্রেণিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণের কারণে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তসহ  বিভিন্ন খাতের পেশাজীবী শ্রেণি সমাজটিকে শাসন করছে আর তাদের প্রতিনিধি শাসক শ্রেণি অনুরূপ সম্পদ-বৈভব নিয়ে পশ্চিমা ভোগবাদী ধারাকে জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাদের কর্মতৎপরতা চরিত্রগুণে সাম্রাজ্যবাদী ধারার অনুসারী।

সেই শাসনযন্ত্র ধনীকে আরও ধনী হতে এবং দরিদ্রকে আরও দরিদ্র হতে সাহায্য করছে। শিক্ষার মতো একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সমাজের শেষ স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চরম উদাসীনতা তাদের শ্রেণিস্বার্থের বাহক হয়ে চলেছে। প্রতিযোগিতাহীন শ্রেণিস্বার্থরক্ষা তাদের লক্ষ্য এবং মূলমন্ত্র। রাষ্ট্রটিকে, সমাজকে তারা সেই ধারায় গড়ে তুলছে। তাই যা কিছু অর্থনৈতিক অগ্রগতি তার সব কিছুই সুবিধাভোগী উচ্চমধ্যবিত্ত ও বিত্তবান শ্রেণির। বিত্তবৈভবের অমিত সঞ্চয়ে তাই দুর্নীতি ও মুনাফাবাজি সামাজিক দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে শাসনযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রেণি বিশেষের প্রভাব প্রতাপ প্রতিপত্তি এতটা বেড়েছে যে, তাদের স্বার্থের বাইরে সমাজ অচল। সমাজের নিম্ন স্তরেও দুর্নীতির বিস্তার, প্রধানত এক ধরনের বাধ্যবাধকতার কারণে।

বাংলাদেশি সমাজের এ বাস্তবতা একুশের চেতনা, কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনোটিরই অনুসারী নয়, বরং বলা যায় এ দুটোরই বিপরীত ধারার। বহুধাবিভক্ত সমাজতন্ত্রী, রাজনীতি অসহায় চোখে এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং কিছু তৎপরতার মাধ্যমে দায় মেটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে মোটেই সক্ষম নয়।

বিশ্বরাজনীতি এখন তাদের বিরুদ্ধে প্রবল এক শক্তি। সেই শক্তির আর্থ-সামাজিক সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাদের নেই। যে পথে বা যে আদর্শে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংগ্রামী যাত্রা তার বিপরীত ধারাই এখন বাংলাদেশের আদর্শিক বাস্তবতায় পরিণত। মুক্তিযুদ্ধ নামেই সামাজিক মুক্তির, তা মূলত স্বাধীনতা বিশেষ করে শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জনেই মুক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছে, এর বেশি কিছু নয়।

রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন, আদর্শবাদী সংগ্রামের ব্যাপকতা ও বর্তমান শ্রেণিস্বার্থের অবসান ঘটিয়ে সমাজবদল এখন একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। সেই সংগ্রামী রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ না ঘটা পর্যন্ত বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না। এর অনুঘটক হলো সচেতন রাজনৈতিক আদর্শের শক্তি ও আদর্শবাদী তারুণ্য, যার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে একুশের চেতনাকে।

 

লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

 

সর্বশেষ খবর