বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

নববর্ষ উদযাপন কাঙ্ক্ষিত সর্বজনীনতার আবিষ্কার

যতীন সরকার

নববর্ষ উদযাপন কাঙ্ক্ষিত সর্বজনীনতার আবিষ্কার

বাংলাদেশ নামে পরিচিত ভূখণ্ডের অধিবাসীরা তীব্র সংগ্রাম ছাড়া তাদের ঐতিহ্যগত কোনো কিছুর ওপরই আপন অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এমনকি মাতৃভাষার অধিকারও আদায় করতে হয়েছে রক্তমূল্যে। মাতৃভাষার বুনিয়াদি বর্ণমালাকে হটিয়ে দেওয়া অথবা বিকৃত করার চক্রান্ত রুখতে হয়েছে আন্দোলন করে। মাতৃভাষার মহত্তম, এবং বিশ্বের সব ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম— কবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অধিকারটুকু পর্যন্ত সংগ্রাম ছাড়া লাভ করা যায়নি। বাঙালির সর্বজনীন উৎসব নববর্ষের ওপরও ছিল কত-না সন্দেহের ভ্রূকুটি ও নিষেধের রক্তচক্ষু। সে-সবকে অগ্রাহ্য করে প্রতিবাদী মনোভঙ্গি নিয়েই বাঙালিকে তার নিজস্ব উৎসব পালনে ব্রতী হতে হয়েছে। আর এভাবে প্রতিবাদী ও আন্দোলনমুখী হতে হতেই একদিন সে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, অপরিমেয় রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছে; তার নিজের মাতৃভাষা, বর্ণমালা, কবি, কবিতা, গান, উৎসব— এককথায় আপন ঐতিহ্যগত সবকিছুর ওপরই নিরঙ্কুশ অধিকার ফিরে পেয়েছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি সব অধিকার ‘নিরঙ্কুশ’ হয়েছে? ঐতিহ্যের অন্যকিছুর কথা আজ আমাদের আলোচ্য নয়, বাঙালি তার স্বাধীন রাষ্ট্রেও বাংলা নববর্ষ উৎসবকেই একান্ত আপনার করে পেয়েছে কি? এই একটি মাত্র ক্ষেত্রের ওপর জাতীয় অধিকারের স্বরূপ করতে পারলেই রোধ হয় ‘গোষ্পদে আকাশ’-এর মতো অন্যসব ঐতিহ্যিক বিষয়ে সব বাঙালির অধিকারের স্বরূপ এতে প্রতিবিম্বিত দেখতে পারি।

দুই.

পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি মধ্যবিত্ত তার নববর্ষ সম্পর্কে নতুন করে সচেতন হয়ে ওঠে। কারণ শাসকরা বাংলা নববর্ষের মধ্যে পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী উপাদান খুঁজে পেয়েছিল। নববর্ষের উৎসব উদযাপন তো ছিল তাদের বিবেচনায়, রীতিমতো প্রকৃতি পূজা এবং বিদেশি ষড়যন্ত্র। কিছু কিছু দালাল বাঙালি ছাড়া আর কেউই বাংলা নববর্ষের এই পাকিস্তানি ভাষ্য মেনে নিতে পারেনি। তাই, একটা চ্যালেঞ্জের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাকিস্তানি শাসনাধীন বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাংলা নববর্ষের দিকে তাকিয়েছে, নববর্ষ উৎসব উদযাপনের মধ্যদিয়ে আপন জাতিগত আত্মাভিমান চরিতার্থ করতে চেয়েছে। শুধু তাই নয়, ধর্মীয় -দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের সন্ধানও মিলেছে বাংলা নববর্ষের মধ্যে। পূজা ঈদ বুদ্ধপূর্ণিমা বড়দিনসহ অনেক উৎসব আবহমানকাল ধরেই এদেশের ঐহিত্যের সঙ্গে যুক্ত। এই উৎসবগুলোর পেছনে অবশ্যই উদার ও মহৎ ভাবনা ক্রিয়াশীল, এগুলোর দর্শন নিশ্চয়ই কোনো সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপোষক নয়, এই উৎসবগুলো উদযাপনের মধ্যদিয়ে মানুষ চিত্তমুক্তিরই সাধনা করে। তবু এ-কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে : আনুষ্ঠানিক বাস্তবে এগুলো সবই হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টানের সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় উৎসব। এই সম্প্রদায়ভুক্ত উদার মতাবলম্বীরা হয়তো পরম ঔদার্য নিয়ে পরস্পরের উৎসবের প্রতি সশ্রদ্ধ দৃষ্টিপাত করেছে, আমন্ত্রিত অতিথিরূপে অংশগ্রহণও করেছে কখনোবা। তবু তাতেও এসবের কোনোটাই ধর্মীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বজনীন উৎসবের রূপ পায়নি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের পরস্পরবিরোধী স্বার্থের টানাপড়েনে যখন দেশের সাম্প্রদায়িক আবহ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, তখন বরং পরম পবিত্র ধর্মীয় উৎসবগুলোকেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কলুষে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে একান্ত অবলীলায় ও নির্বিবেক হৃদয়হীনতায়। দোলযাত্রা ও কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে এদেশে যে এক সময় নারকীয় বীভৎসতার প্রদর্শনী চলেছে, উৎসবের পরিণতি ঘটেছে ভ্রাতৃঘাতী পৈশাচিকতায়,— সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো এদেশের মানুষের স্মৃতি থেকে আজও মুছে যায়নি। এ-ধরনের দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকুক,— সুস্থ চিন্তার অনুসারী মানুষ কখনো তা চায় না, ধর্মীয় উৎসবে ধর্মের মর্মের উদার প্রকাশই তাদের কাম্য। তাই তারা এমন উৎসবেরও সন্ধান করে যে-উৎসব সাম্প্রদায়িকতার কলুষমুক্ত, সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সমগ্র জাতির যা ঐতিহ্যিক সম্পদ। বাংলা নববর্ষ উৎসবের মধ্যে সেই কাঙ্ক্ষিত সর্বজনীনতাকে আবিষ্কার করে বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল অংশ আনন্দে উদ্বেলিত হলো। ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ তথা বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অন্যতম আয়ুধে পরিণত হলো এই উৎসব। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এ-উৎসব রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেল, অফিস আদালত স্কুল কলেজে ছুটি পেয়ে মধ্যবিত্ত চাকুরে বাঙালির উৎসব দিনটিকে নানাভাবে উপভোগ করারও মওকা মিলল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের বৃত্ত ভেঙে সমাজের বৃহত্তম অংশে এ-উৎসবের বিস্তৃতি ঘটতে পারল না। যা হতে পারত বাঙালির জাতীয় উৎসব, বস্তুত তা-ই জাতির এক সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশের বার্ষিক পার্বণ মাত্র হয়ে রইল। এ রকম খণ্ডীভবন কোনো উৎসবেরই মর্যাদা বাড়ায় না, তার উৎসবত্বের অবমাননাই করে বরং। যা খণ্ডিত, যা সংকীর্ণ, যা সবাইকে অভিন্ন মিলনক্ষেত্রে উদার আমন্ত্রণ জানায় না, তাকে ‘উৎসব’ অভিধা দেওয়া শব্দটির অপপ্রয়োগ মাত্র। বছরের প্রতিটি সাধারণ দিনের সঙ্গে উৎসবের দিনের পার্থক্য নির্দেশ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী— কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ; সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তোলার জন্য তার মন্তব্য : ‘... উৎসবের দিন শুধুমাত্র ভাবরস সম্ভোগের দিন নহে, শুধুমাত্র মাধুর্যের মধ্যে নিমগ্ন হইবার দিন নহে... বৃহৎ সম্মিলনের মধ্যে শক্তি-উপলব্ধির দিন, শক্তিসংগ্রহের দিন।’

আজকে বাংলাদেশে যে নববর্ষ উৎসব পালিত হয়, রবীন্দ্রনাথ-কথিত উৎসবের ওই অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যসমূহ তাতে অনুপস্থিত। এ-উৎসব যদিও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ নয়, সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সব বাঙালিই একে আপন বলে ভাবতে পারে যদিও, তবু একটি বিশেষ শ্রেণির গণ্ডি অতিক্রম করে তা বৃহৎ ও মহৎ হয়ে উঠতে পারেনি।

তিন.

অথচ বৃহৎ ও মহৎ হওয়ার সব উপাদানই বাঙালির নববর্ষের মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি যদিও ঔপনিবেশিক প্রকৃতির পাকিস্তানি দুঃশাসনের ফলেই আত্মচেতন হয়ে তার ঐতিহ্যের খোঁজ করতে করতে নববর্ষের সন্ধান পেয়েছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবী বাঙালিকে কিন্তু তেমনটি করতে হয়নি। কারণ কৃষিকেন্দ্রিক ঐতিহ্যের মধ্যেই বাঙালির বর্ষচেতনার উদ্ভব। শুধু নববর্ষ নয়, বর্ষের শুরু থেকে শেষ অবধি প্রসারিত দিন ও মাসগুলোর সবই কৃষিসংশ্লিষ্ট নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। পণ্ডিতেরা বলেন, নববর্ষ মূলত আর্তব বা ঋতু-উৎসব, মানব-সভ্যতা কৃষিযুগে পরিণত হওয়ার পর থেকে তাই বিবর্তিত হয়েছে কৃষি-উৎসবে। এখনো গ্রাম বাংলায় যে— রীতিতে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে তাতে আর্তব উৎসব ও কৃষি-উৎসব দুয়েরই উপাদান জড়িত— মিশ্রিত হয়ে আছে। এর সঙ্গে যে কোনো ধ্রুপদী ধর্মেরই আনুষ্ঠানিকতার কোনো যোগ নেই— আচার্য যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, অধ্যাপক চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, ড. মুহম্মদ এনামূল হক প্রমুখ বিদ্বজ্জনের আলোচনাতেই এ— সত্য পরস্ফুিট হয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবীর সব জাতির নববর্ষের মতো বাঙালি নববর্ষও একটি ধর্মনিরপেক্ষ লৌকিক উৎসব। অন্যান্য লৌকিক উৎসবের মতোই এতেও আছে নানা আঞ্চলিক বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য, এবং ওই সব বৈচিত্র্যই আবার উদ্দেশের ঐক্যে অভিন্ন। সে-অভিন্নতা প্রকাশিত প্রকৃতিকে জয় করার ইচ্ছার মধ্যে, সুন্দর জীবনের জন্য আকুল কামনার মধ্যে সবার প্রতি সযত্ন ভালোবাসার মধ্যে। কোনো লৌকিক উৎসব যখন বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতাগুলোকে সমন্বিত করে একক একটি রূপে সংবদ্ধ হয়ে ওঠে, তখন তা-ই উত্তরিত হয় জাতীয় উৎসবে। এমনি করেই ইরানের লৌকিক নববর্ষ নওরোজে পরিণত হয়ে শুধু জাতীয় নয়, প্রায় আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করে বসে। ইরানের সীমানা ছাড়িয়ে অন্যত্রও তার প্রসার ঘটে যায়। এমনকি ধর্মের নামে জারি করা কোনো বিধানও এই নওরোজকে অবলুপ্ত করতে পারেনি, ধর্মীয় বিধিনিষেধের মোকাবিলা করতে গিয়ে এটি বরং আরও বিপুল প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। সামন্ততান্ত্রিক যুগের শ্রেণিবৈষম্যের মধ্যেও এ জাতীয় উৎসবের পক্ষে সর্বশ্রেণিকে হয়ে যেতে তেমন কোনো বাধার সৃষ্টি হয়নি। শাসক আর শাসিত শ্রেণির মধ্যে উৎসব উদযাপনের পদ্ধতিতে পার্থক্য নিশ্চয়ই ছিল, তবুও উৎসবের মর্মমূলের ঐক্যচেতনাই একে সর্বজনীন করে তোলে।

কিন্তু সমান্ত যুগ পর্যন্ত এক রকম চললেও ধনবাদী সমাজকাঠামোতে উৎসবের শ্রেণি-চরিত্র প্রকটিত হয়ে পড়ে অত্যন্ত বিশ্রী চেহারায়। যে-দেশে সমাজ বিকাশের স্বাভাবিক নিয়মে সামন্ততন্ত্র উত্তীর্ণ হয়েছে ধনতন্ত্রে, সে দেশে অবশ্যি উৎসব অনুষ্ঠানেও চূড়ান্ত বিপর্যয়কর কোনো খণ্ডীভবন ঘটেনি। কিন্তু ঔপনিবেশিক আধিপত্য চেপে বসেছে যে-সব দেশে, সে-সব দেশের সামাজিক বিন্যাসে দেখা দিয়েছে এক অষ্টাবক্র বিসদৃশ্যতা। এ-সব দেশের নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি ঔপনিবেশিক দাক্ষিণ্যে সৃষ্ট এবং এ-কারণেই একান্ত অনিকেত ও সামাজিক ঐতিহ্যের প্রবাহ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। সে-বিচ্ছিন্নতার দরুনই এ-শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত মানুষগুলোর চিন্তার প্যাটার্নটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের থেকে পৃথক। সে-পার্থক্যই তাদের উৎসব-চেতনার মধ্যেও প্রতিবিম্বিত। নিজের ঐতিহ্যগত উৎসবের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ওরা যখন বিদেশি ও বিজাতীয়দের উৎসবের বর্ণাঢ্যতা প্রত্যক্ষ করে, তখন তাদের মধ্যে একটা নস্টালজিক অনুভূতি ক্রিয়া করতে থাকে। সেই অনুভূতিই তাদের ঐতিহ্যের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু সমাজের মূল প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন অনিকেত শ্রেণির মানুষদের পক্ষে ঐতিহ্যলগ্ন হওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই। তাই তাদের অনেকে ঐতিহ্যের নামে বিজাতীয় প্রভুদের নকলনবিশিতেই তৃপ্তি পেতে চায়। আবার কেউ-বা কূপমণ্ডূকতায় এমনই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, দেশীয় ও জাতীয় ঐতিহ্যের ছদ্মাবরণে কুসংস্কার ও পশ্চাত্পদতারই নান্দীপাঠে মেতে ওঠে। এমনটিই দেখি বাংলাসাহিত্যের ‘সন্ধিযুগের কবি’ বলে খ্যাত ঈশ্বরগুপ্তে, যিনি ‘বিদেশের ঠাকুর ফেলে দেশের কুকুর’ ধরার মধ্যেই স্বদেশ প্রেমের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন। ইংরেজের নববর্ষ উৎসবকে ব্যঙ্গ করে কত পদ্য পঙিক্তইনা তিনি রচনা করেছিলেন। কিন্তু নেতিবাচক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ জাতির আত্মাকে তৃপ্ত করতে পারে না। মানুষ চায় সদর্থক চেতনার শক্তভূমিতে দাঁড়াতে, এবং তারই সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অনুষ্ঠানকে অবলম্বন করে জাতীয় আত্মাভিমানের পরিতৃপ্তি সাধন করতে। তাই, উনিশ শতকের নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালি ও ঈশ্বরগুপ্তীয় স্থূল স্বাদেশিকতার বৃত্তে বন্দী থাকে না। ইংরেজের নববর্ষ পালনকে কেবল ব্যঙ্গ না-করে তারা বরং নিজেদের ঐতিহ্যগত উৎসবগুলোর দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বাংলায় নববর্ষকেও নতুনভাবে আবিষ্কার করে। কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথই বোধহয় বাংলার নববর্ষ উৎসবকে সর্বপ্রথম পরিমার্জিত ও নবায়িত করে তোলেন। নববর্ষই নয় শুধু, অন্যান্য ঋতু উৎসবগুলোর নবায়নও তারই অবদান। ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক উৎসব রূপে বৃক্ষরোপণ তথা বন-মহোৎসবরেরও প্রবর্তন করেন তিনিই। তার শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন হয়ে দাঁড়ায় এসব উৎসবের প্রয়োগ-ক্ষেত্র। প্রকৃতি থেকে, কৃষিকেন্দ্রিক জীবন থেকে—তথা ঐতিহ্য থেকে—বিচ্ছিন্নতা ঘুচানোর লক্ষ্যই সক্রিয় ছিল রবীন্দ্র-পরিকল্পিত উৎসবগুলোর মূলমর্মে। কিন্তু দুঃখ এই : রবীন্দ্রনাথের মতো কবি-মনীষীর একান্ত সদিচ্ছামূলক প্রয়াসও যে পুরোপুরি লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছে— তেমন কথা বলা যাবে না। বর্ষামঙ্গল বা বসন্ত-বরণের মতো নববর্ষও, আগেই বলেছি, এখনো পর্যন্ত নাগরিক মধ্যবিত্তের অনুষ্ঠান হয়েই রয়েছে; এ-সবের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগণের জীবন-চেতনার কোনো প্রতিফলন পড়েনি; জাতীয় ঐতিহ্যলগ্নতার ঢাকঢোল যতই পিটানো হোক, আসল জাতীয় ঐতিহ্য থেকে এগুলোর বিচ্ছিন্নতা একান্তভাবেই প্রকট। আবার, কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলার মানুষের দুর্ভাগ্য : তারা শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে অনুষ্ঠেয় উৎসবের সঙ্গে যেমন যুক্ত হতে পারেনি, তেমনি বিযুক্ত হয়ে গেছে আবহমান কালের উৎসব অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা থেকেও। এ-বিযুক্তি ঘটানোর ব্যাপারে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে তথাকথিত পাকিস্তানি তমদ্দুন। ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা করে সেই তমদ্দুনের ধ্বজাধারীরা গ্রাম বাংলার মানুষের কণ্ঠ থেকে প্রাণময় সংগীত কেড়ে নিয়েছে, ঐতিহ্যগত উৎসবের আনন্দকে নিষেধের বেড়াজলে আটকে দিয়েছে। গ্রামের কৃষকদের অনেকেই এখনো ধর্মনিরপেক্ষ লৌকিক রীতিতেই নববর্ষকে বরণ করে বটে, কিন্তু যান্ত্রিক অভ্যাসানুবর্তিতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি তা। তমদ্দুনী প্রচার সরলপ্রাণ কৃষকের অন্তঃকরণে অহেতুক পাপবোধ ঢুকিয়ে দিয়েছে; তাই উৎসবের আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ততা নেই আজকের কৃষকের বর্ষবরণের মধ্যে। অর্থাৎ বাংলার নববর্ষ উৎসবের খণ্ডীভবন ঘটেছে।

সর্বত্র-শহরে এবং গ্রামে, শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত, মধ্যবিত্তে এবং কৃষকে। সচেতন প্রয়াসে এই খণ্ডীভবনকে দূর করতে না পারলে বাংলার নববর্ষের দিনটি কিছুতেই ‘বৃহৎ সম্মিলনের মধ্যে শক্তি-উপলব্ধির দিন’ও ‘শক্তিসংগ্রহের দিন’ হয়ে উঠবে না। এবং সে-কারণেই উৎসবের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃত উপাদান থেকে তা বঞ্চিতই থেকে যাবে। বাঙালি মধ্যবিত্তের যে-প্রগতিচেতন সদস্যরা নববর্ষকে আবিষ্কার করেছিল বিজাতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার রূপে, তাদের উপরই আজ দায়িত্ব বর্তেছে সে-হাতিয়ারকে শাণ দিয়ে জাতীয় শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের হাতে তুলে দেওয়ার। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মানে উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট কৃষক-শ্রমিক তথা সব মেহনতি জনগণ। নববর্ষ তো তাদেরই উৎসব। বাস্তবে তারাই যদি তাদের উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকে, তবে রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরও আপন ঐতিহ্যের উপর জাতীয় অধিকার নিরঙ্কুশ হলো কী করে? উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন অনিকেত মধ্যবিত্তের ঐতিহ্য-প্রীতি আসলে ঐতিহ্য-বিলাস মাত্র। সেই বিলাসের নির্মোক ভেঙে উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট জনগণের মধ্যে নেমে এলেই প্রকৃত ঐতিহ্যকে শনাক্ত করা সম্ভব এবং তখনই পয়লা বৈশাখের শহুরে কৃত্রিমতার সঙ্গে আবহমান বাংলার প্রাণবান নববর্ষ উৎসবের পার্থক্যটাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তেমনটি যেদিন হবে সেদিনই এ-উৎসবের খণ্ডীভবন ঘুচে যাবে এবং সেদিনই এটি সমগ্র বাঙালির যথার্থ জাতীয় উৎসবে পরিণত হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ।

সর্বশেষ খবর