১৮ এপ্রিল, ২০১৬ ১৮:০৮

সুন্দরবনে ১৪ বছরে আগুন লেগেছে ২১ বার

শেখ আহ্সানুল করিম, বাগেরহাট:

সুন্দরবনে ১৪ বছরে আগুন লেগেছে ২১ বার

ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনের গহীন অরণ্য গত ১৪ বছরে ২১ বার আগুনে পুড়েছে । গত ১২ এপ্রিল রাতে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্পের আব্দুল্লার ছিলার আগুন দু'দিন ধরে জ্বলার পর একই স্থানে সোমবার সকালে আবারও আগুন লাগে। সর্বশেষ একই এলাকায় মাত্র ২৩ দিনের মধ্যে তিন বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।

শুধুমাত্র বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় লাগা এসব আগুনে প্রায় ৭০ একর বন পুড়ে ছাই হয়েছে। সুন্দরবনকে আগুনে পুড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষায় নেই বন বিভাগের কোন নিজস্ব অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা।

২০০২ সালের ২২ মার্চ সুন্দরবনের কটকা অভয়ারণ্যে আগুন লেগে প্রায় ১৫দিন ধরে জ্বলতে থাকে। পুড়ে যায় হাজার হাজার গাছ। সেই থেকে শুরু হয় পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। প্রতিটি আগুন লাগার পর পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ দায়সারা তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের দায়িত্ব শেষ করে। কে বা কারা, কি উদ্দেশ্যে এসব আগুন লাগিয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের নাম-পরিচয় উঠে আসে না এসব তদন্ত রির্পোটে। ফলে অপরাধীরা সব সময় থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুন্দরবনের এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের অভিযোগ। সুন্দরবন বিভাগের প্রতিটি তদন্ত রিপোর্টে জেলে-মৌয়াল বা বনজীবীদের বিড়ি-সিগারেট বা ফেলে দেয়া মশাল থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে বার-বার উল্লেখ করে অজ্ঞাতদের দায়ী করা হয়। গোটা সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জের মধ্যে কোন যাদুবলে শুধুমাত্র চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় একের পর এক আগুন লাগছে- এ নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

সুন্দরবনসহ উপকূলের অপরাধ জগতের হাল নাগাদ খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক সূত্র বলছে, দু'একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া অনেক সময় এক শ্রেণির অসাধু বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শাসকদলের প্রভাবশালীরা সুন্দরবনের খাল-বিল কথিত ইজারার মাধ্যমে মাছ চাষ করতে পরিকল্পিতভাবে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১২ এপ্রিল রাতে ও সোমবার সকালে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্পের আব্দুল্লারছিলায় বনে আগুনের ঘটনাটি নিয়ে এবার এমন অভিযোগ তুলেছে খোদ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম। তিনি এবার দাবি করেছেন, ১২ এপ্রিল রাতে সুন্দরবনে দেওয়া আগুনের ঘটনায় বন বিভাগ রবিবার আদালতে যে ৬ জনকে আসামি করে মামলা করেছে, তারা বা তাদের সহযোগীরা আবারও সুন্দরবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ প্রতিটি অগ্নিকান্ডে পুড়ে যাওয়া বন ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কম করে দেখালেও সঠিক সংখ্যাটি রেকর্ড করে রেখেছে। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে গত ১৪ বছরে ২১ বার বড় ধরণের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বিগত ২০০২ সালের ২২ মার্চ কটকা অভয়ারণ্যে প্রায় ১৫দিন ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে পুড়ে যায় ৬ একর বনভূমি। এরপর থেকে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনা ঘটতে থাকে। এরপর ২০০৪ সালের ২৫ ও ২৭ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধরা স্টেশনের নাংলীর মাদ্রাসার ছিলায় ও আড়িয়ার খাল এলাকায় বনের ভিতর দু'দফা অগ্নিকান্ড ঘটে। ২০০৫ সালের ৮ এপ্রিল একই রেঞ্জের আমরবুনিয়া এলাকায় অপর একটি অগ্নিকান্ডে আড়াই একর এলাকার বন পুড়ে যায়। ১৩ এপ্রিল একই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের তুলাতলা এলাকায় আগুনে পুড়ে যায় সাড়ে ৪ একর বন। ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের তেরাবেকা এলাকায় সৃষ্ট দাবানলে পুড়ে যায় প্রায় দেড় একর বনভূমি। ওই বছরের ১২ এপ্রিল আমরবুনিয়া এলাকায় বন আগুনে পুড়ে যায়। একই দিন ওই এলাকার কলমতেজিতে পুড়ে যায় দেড় একর বনভূমি। ১ মে চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধরা স্টেশনের নাংলীর ডালিয়া বিলের বন আগুনে পুড়ে যায়। ৩ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টের আড়াই একর বন পুড়ে যায়। ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি শরণখোলা রেঞ্জের ডুমুরিয়া ক্যাম্পের সাড়ে ৫ একর বন পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। ওই বছরের ১৯ মার্চ ও ২৮ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলীর পচাকুড়ালিয়া এলাকায় দু'দফা আগুনে ১০ একর বন পুড়ে যায়। ২০১০ সালের ২০ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের ২৭ নম্বর কম্পার্টমেন্টের ৫ একর বন পুড়ে যায়। ২০১১ সালে মার্চ মাসে তিন দফা অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ১ মার্চ নাংলী এলাকার ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টে প্রথম দফা অগ্নিকান্ডে দুই একর এলাকার বনসম্পদ পুড়ে ছাঁই হয়। টানা তিনদিন পর এ আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ৮ মার্চ আড়িয়ার বেড় নদী থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ভিতরে আবার আগুন লাগে। এ আগুন নেভাতে না নেভাতেই ৯ মার্চ ভোলা নদী থেকে প্রায় ২কিলোমিটার দূরে গহীন বনে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠে। বনবিভাগ দমকল বাহিনী এবং এলাকাবাসীর সহায়তার চারদিনের মাথায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তিন দফা আগুনে প্রায় দশ একর এলাকার বনসম্পদ পুড়ে যায়। ২০১৪ সালের ২১ মে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের ৬৫ ছিলায় আগুনে সাড়ে তিন একর বন পুড়ে যায়। চলতি বছরের ২৭ মার্চ বিকালে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাদঁপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলীর শিকদারের ছিলায় এলাকার আগুনে পুড়ে যায় ১০ একর বনভূমি। ১২ এপ্রিল রাতে নাংলী ক্যাম্পের আব্দুল্লার ছিলার আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ১০ একর বন। সর্বশেষ আজ সোমবার ১৮ এপ্রিল একই এলাকায় আগুন লাগে।

তবে সুন্দরবনে এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনা নিয়ে হয় না কোন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত। হয় না সাজা। এ কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ধ্বংসের কুশিলবরা। স্থানীয় সচেতন মহল বলছেন, সুন্দরবনে আগুন লাগার পেছনে বন কর্মকর্তাদেরও হাত রয়েছে। তারাই প্রভাবশালীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আগুন দিয়ে বন পুড়িয়ে মাছ চাষের জন্য কথিত ইজারা দেওয়ার ফন্দি করছে। এর মাধ্যমে সুন্দরবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার বনকর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করলে পেছনের কুশিলবরাও বেরিয়ে আসবে।


বিডি-প্রতিদিন/১৮ এপ্রিল ২০১৬/ এস আহমেদ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর