২৮ মার্চ, ২০১৭ ২৩:২৭

অপারেশন টোয়াইলাইটের সফল সমাপ্তি

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট:

অপারেশন টোয়াইলাইটের সফল সমাপ্তি

যে লক্ষ্য নিয়ে সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডোরা ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ শুরু করেছিলেন, সে লক্ষ্যে তারা পুরোপুরি সফল হয়েছেন। গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া সেনা কমান্ডোদের এই অভিযান মঙ্গলবার বিকেলে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। অপারেশন টোয়াইলাইটে চার জঙ্গিকে নির্মুল করেছেন সেনা কমান্ডোরা। এ অভিযান মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মন্তব্য সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। এদিকে, মঙ্গলবার আতিয়া মহলে নিহত দুই জঙ্গির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তাদের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করে লাশ ওসমানী হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। বিকেলে আতিয়া মহল পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী।

জঙ্গিরা অবস্থান করছে, এমনটা নিশ্চিত হয়ে সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়াস্থ আতিয়া মহল গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আনুমানিক ৩টায় ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুক্রবার বিকেলে অভিযানে যোগ দেয় সোয়াত। তবে পুলিশ বা সোয়াত সদস্যরা পাঁচতলা ওই ভবনে থাকা বাসিন্দাদের নিরাপত্তা ও বিস্ফোরকের ঝুঁকিসহ নানা দিক বিশ্লেষণ করে অভিযানে সেনাবাহিনীর সাহায্য চান। শনিবার সকাল থেকে সেনা কমান্ডোরা শুরু করেন ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। অভিযানের দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন সেনা কমান্ডোরা। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল আতিয়া মহলে আটকাপড়া নিরীহ বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনা। অন্যটি ছিল জঙ্গিদের নির্মুল করা। 

কমান্ডোরা অভিযানের শুরুতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আতিয়া মহলে আটকা পড়াদের উদ্ধার কাজ শুরু করেন। পাশের চারতলা ভবন থেকে পাঁচতলা ভবনে মই লাগিয়ে একে একে উদ্ধার করা হয় ৭৮ বাসিন্দাকে। এরমধ্যে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১টি শিশু ছিল। জঙ্গিরা আতিয়া মহলের বিভিন্ন স্থানে রূপান্তরিত বিস্ফোরক (আইইডি) লাগিয়ে রাখায় এই উদ্ধার অভিযান ছিল চরম ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু কোন ধরনের হতাহতের ঘটনা ছাড়াই সকল বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে আনতে সক্ষম হন কমান্ডোরা।

প্রথম লক্ষ্যে সফল হওয়ার পর দ্বিতীয় লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন সেনা কমান্ডোরা। কমান্ডোদের সাথে স্নাইপার দল এপিসিসহ বিশেষায়িত অনেক সদস্য ছিলেন। সেনা কমান্ডোদের বিরুদ্ধে জঙ্গিরা গ্রেনেড, রূপান্তরিত বিস্ফোরক, স্মল আর্মস দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে। একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। তবে দুর্ধর্ষ কমান্ডোদের দুঃসাহসী অভিযানে পরাস্ত হয় জঙ্গিরা। একে একে আতিয়া মহলের চার জঙ্গিই নিহত হয়। নিজেদের কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই দ্বিতীয় লক্ষ্যেও সফল হন সেনা কমান্ডোরা।

দুই জঙ্গির ময়নাতদন্ত: 
আতিয়া মহলে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে দুজনের ময়নাতদন্ত মঙ্গলবার সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে এক পুরুষ ও এক নারী জঙ্গির লাশ ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শামসুল আলমকে প্রধান করে তিন সদস্যের বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের অপর দুই সদস্য হচ্ছেন- ডা. তাহমিনা আক্তার ও নাদিয়া শারমিন। বেলা ১২টার কিছুক্ষণ পর শুরু হয় ময়নাতদন্ত। এক পুরুষ জঙ্গির ময়নাতদন্ত শেষ হয় বেলা ২টা ৪০ মিনিটে। পরে বিকাল পৌনে ৪টায় শেষ হয় নারী জঙ্গির ময়নাতদন্ত। লাশ দুটি ওসমানী হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।

পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ: 
নিহত জঙ্গিদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ টেস্ট করা হবে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জেদান আল মুসা। তিনি বলেন, নিহত জঙ্গিদের ডিএনএ’র নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হবে। পরিচয় শনাক্ত হলে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে। অন্যথায় বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফন করা হবে।

বোমা হামলা মামলায় গ্রেফতার নেই: 
আতিয়া মহলে অভিযান চলাকালে গত শনিবার সামান্য দূরে দুই দফায় বোমা হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আজ রাত সোয়া ৮টার দিকে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার জেদান আল মুসা এ তথ্য জানিয়েছেন।

মানুষের দুর্ভোগ: 
আতিয়া মহলে যেদিন থেকে অভিযান শুরু হল, সেদিন থেকেই পুরো শিববাড়ি এলাকার মানুষের দুভোগের শুরু। অভিযানকালে এলাকার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় চরম ভোগান্তি পোহাতে থাকেন সাধারণ মানুষ। বুধবার গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ পুনরায় চালু হতে পারে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে, দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে পীর হবিবুর রহমান চত্বর পর্যন্ত এলাকায় যানবাহন চলাচলে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল পুলিশ, আজ রাত সাড়ে ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তা বলবৎ রয়েছে।

প্রসঙ্গত, প্রায় তিন মাস আগে একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয়ে আতিয়া মহলের নিচ তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় কাওছার নামের একজন। সাথে তার স্ত্রী মর্জিনা ছিলেন। তবে নাম দুটি সঠিক ছিল কিনা, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কাওছার নামক ব্যক্তির ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটি জঙ্গি ঘাঁটি, এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে আতিয়া মহল ঘেরাও করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিষয়টি টের পেয়ে শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে ভেতর থেকে দুটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। ওইদিন বিকেলে অভিযানে যোগ দেয় সোয়াত। রাতে ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণে আসে সেনা কমান্ডোরা। বিস্ফোরক দিয়ে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলায় এবং পাঁচ তলা ভবনের ২৯টি ফ্ল্যাটে নিরীহ লোকজন থাকায় অভিযানের দায়িত্ব পড়ে সেনা কমান্ডোদের উপর। শনিবার সকাল সোয়া ৯টা থেকে অভিযান শুরু করেন কমান্ডোরা। বেলা ২টার মধ্যে তারা ওইসব ফ্ল্যাট থেকে ৭৮ জন বাসিন্দাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে আসেন। সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই উদ্ধার অভিযানই ছিল তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাতে সফল হওয়ার পর বেলা ২টার পর থেকে শুরু হয় জঙ্গি দমন অভিযান। শনিবার সেনা বাহিনীর প্রেস ব্রিফিংয়ের কিছুক্ষণ পরেই আতিয়া মহলের অদূরে দুই দফায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয় জন নিহত হন। গত রবিবার দুই জঙ্গি নিহত হওয়ার তথ্য দেয় সেনাবাহিনী। পরে গত সোমবার সন্ধ্যায় ভেতরে থাকা চার জঙ্গির নিহত হওয়ার বিষয়টি জানায় সেনাবাহিনী। মঙ্গলবার আতিয়া মহল পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে অপারেশন টোয়াইলাইট সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।

 


বিডি-প্রতিদিন/২৮ মার্চ, ২০১৭/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর