২৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ১১:১০
'জাস্টিস ফর বাদল' নামে অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষরের আবেদন

খুন না করেও ১০ বছর ভারতের তিহার জেলে বন্দী বাংলাদেশি বাদল (ভিডিওসহ)

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

খুন না করেও ১০ বছর ভারতের তিহার জেলে বন্দী বাংলাদেশি বাদল (ভিডিওসহ)

দিল্লির তিহার জেলে (সংশোধনাগার) গত ১০ বছর ধরে বন্দি আছেন বাংলাদেশের নাগরিক বাদল ফরাজি।  বাগেরহাটের মংলা বন্দরের কাছে ১৭ নম্বর ফারুকি রোডের বাসিন্দা আবদুল খালেক ফরাজি ও সারাফালি বেগমের পুত্র এই বাদল ফরাজি।  টিএ ফারুক স্কুলের অষ্টম শ্রেণি পাশ বাদলের ইচ্ছা ছিল তাজমহল দেখবে।  ছেলেকে একা ঘরের বাইরে ছাড়তে চাইছিলেন না বাবা-মা।  পরে ছেলের জেদের কাছে হার মানেন তারা।

২০০৮ সালের ১৩ জুলাই দুপুরে বেনাপোল অভিবাসন কার্যালয়ে সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে ভারতের হরিদাসপুর সীমান্তে প্রবেশের পরই খুনের অপরাধে বাদলকে আটক করে বিএসএফ।  হিন্দি বা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে না পারার খেসারত দিতে হয় কিশোর বাদলকে।  বিএসএফ’এর কর্মকর্তাদের বোঝাতেই পারেনি যে খুনের অভিযোগ যে বাদলকে খোঁজা হচ্ছে তিনি সেই ব্যক্তি নন।

উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে ৬ মে দিল্লির অমর কলোনিতে এক বৃদ্ধাকে খুনের অভিযোগে বাদল সিং নামে এক ব্যক্তিকে খুঁজছিল পুলিশ।  তাকে ধরতে সীমান্তেও সতর্ক করা হয়েছিল কিন্তু শুধু দুই জনের নাম এক হওয়ার কারণেই বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফরাজি’কেই হাজতে ঢুকতে হয়।

এরপর হরিদাসপুর থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে বাদল ফরাজি’কে নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লিতে।  খুনের অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ নম্বর ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয় বাদলের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট বাদলকে দোষী সাব্যস্ত করে দিল্লির সাকেট আদালত।  বাদলের যাবজ্জীবন  হয়। 

পরবর্তীতে দিল্লি হাইকোর্টও নিম্ন আদালতের সেই রায় বহাল রাখে।  পরে তার স্থান হয় দিল্লির তিহার জেলে।  কিন্তু বিনা দোষে এই সাজা কোনভাবেই মেনে নেননি বাদল।  দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় রায় চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন বাদল।  কিন্তু শীর্ষ আদালতও বাদলের আবেদন খারিজ করে দেয়।  ফলে গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জেলের কুঠুরিতে কাটাতে হচ্ছে বাদল (২৮)-কে। 

বর্তমানে তিহার জেলের ৩ নম্বর কুঠুরিতে রয়েছেন বাদল।  গত এক দশক ধরেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে সমস্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।  দিল্লিতে বৃদ্ধা খুনের সময় তিনি যে ভারতেই ছিলেন না- তাও জানিয়েছেন তিনি।  তার কথা শুনে কারাগারের অন্য কয়েদিরা ও জেল কর্তৃপক্ষেরও বিশ্বাস, বাদল মিথ্যা বলছেন না।  কারাগার কর্তৃপক্ষও বাদলের সংযত ও ভাল ব্যবহারের প্রশংসা করছে। 

বাদল যখন কারাগারে আসেন তখন বাংলা ছাড়া আর কোনো ভাষাই জানতেন না।  কিন্তু গত এক দশকে কারাগার থেকেই প্রথমে দশম শ্রেণি পাশ করেন, পরে দ্বাদশ।  স্নাতকও সম্পন্ন করেছেন বাদল।  জেল চত্ত্বরে থেকেই ইন্দিরা গান্ধী ওপেন ইউনির্ভাসিটি থেকে প্রতিটি পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হয়েছেন।  একটা সময় যে ভাষা সমস্যার কারণে তাকে এতবড় শাস্তি পেতে হয়েছিল আজ সেই বাদল ইংরেজি বা হিন্দিতে অনর্গল কথা বলছেন।  ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সার্টিফিকেট কোর্সও করেছেন।  কয়েক দিন আগে তিহার জেল থেকে দিল্লির মান্দোলি জেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছে বাদলকে, সেখানে দায়িত্বের সাথে জেল সেবাদারের কাজ করছেন। 

২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে বাদলকে মুক্তির ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়েছিল দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশন। চিঠিতে জানানো হয়, ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাদল ফরাজি ভারতে আসে।  দিল্লিতে ওই বৃদ্ধাকে খুন করা হয় ২০০৮ সালের ৫ মে। খুনের পর ভারতে এলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে অপরাধের বোঝা বইয়ে বেড়াতে হচ্ছে।  কিন্তু তারপরেও কারাগার মুক্তির স্বাদ পাননি বাদল। 

এবার সেই বাদলকে অবিলম্বে জেল থেকে মুক্ত করতেই মাঠে নেমেছেন সমাজসেবী রাহুল কাপুর।  রাহুল বর্তমানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইডি করছেন।  স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনার সময়েই হাতে-কলমে শিক্ষা নিতে ২০১৬ সালে তিহার জেলে আসেন রাহুল।  সেই থেকে এখনও পর্যন্ত স্বেচ্ছাশ্রম (ভলানটিয়ার সার্ভিস) দিয়ে আসছেন তিনি। 

জেলের বন্দিদের পুনর্বাসন, তাদের কাউন্সেলিং-এর কাজ করতে করতেই বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফারাজির সাথে পরিচয় হয় রাহুল কাপুরের। বাদলের ঘটনা প্রচণ্ড নাড়া দেয় রাহুলকে।  তিনি জানতে পারেন, মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে বাদলকে।  সব শুনে নতুন লড়াই শুরু হয় রাহুলের।  এই লড়াই ভারতীয় কারাগার থেকে বাদলকে মুক্তি করার, এই লড়াই একজন স্বাধীন নাগরিক হিসাবে নিজের দেশে বাদলের ফিরে যাওয়ার লড়াই।  বাদলের ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ ভুলে সম্মিলিতভাবে অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

রাহুল জানান, আমি জানি যে কোন লোকের কাছেই এটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না।কিন্তু বাদলের এই ঘটনা ‘ট্রাজিক স্টোরি’র মতো।  ছবির থেকেও কোন অংশে কম নয়।'

রাহুল আরও জানান, বাদলের বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে আমি দিল্লিতে বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনার সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরী, হাইকমিশনের মিনিস্টার (কনস্যুলার) মোশারফ হোসেন-এর সাথে দেখা করি। তারা জানান, বাদলের মুক্তির ব্যাপারে তারা ইতিমধ্যেই একাধিক চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু ভারত সরকারের কাছ থেকে তাদের কাছে কোন সদুত্তর আসেনি।  বাদলকে মুক্তির জন্য অভিজ্ঞ আইনজীবী দিয়ে আদালতে আইনি লড়াইও চালানো হয়েছে।

বন্দি চুক্তির অধীনে বাদলকে বাংলাদেশের কোন কারাগারে স্থানান্তরিত করার জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ হাইকমিশনের তরফেও আবেদন জানানো হয়েছে ভারত সরকারের কাছে।  হাইকমিশনের কর্তকর্তারা জানাচ্ছেন, কিছু কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে বাদলের বিষয়টি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও)-এর সাথে সরাসরি যোগাযোগও করা যাচ্ছে না।  যদিও হাইকমিশনের তরফে বাদলের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য প্রদান করা হয় রাহুলকে। 

রাহুল জানান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অফিসে চিঠি লিখে বাংলাদেশি নাগরিক বাদল ফরাজির বিষয়টিতে হস্তক্ষেপের আবেদন জানিয়েছি, যাতে বাদল একজন স্বাধীন নাগরিক হিসাবে নিজেদের দেশে বসবাস করতে পারেন। 

রাহুল জানিয়েছেন, গত দশ বছরে বাদল অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে গেছেন।  বাবাকে হারিয়েছেন।  তার মুক্তির ব্যাপারে সকলের কাছে সম্মিলিত হস্তক্ষেপ করতে আবেদন জানাচ্ছি, যাতে সে তার নিজের দেশে ফিরে গিয়ে মা ও পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারেন। ওঁর সামনে এখনও অনেক সময় পড়ে আছে, বিনা অপরাধে তার আর কারাগারের মধ্যে থাকাটা উচিত নয়।

অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করার আবেদন জানিয়ে রাহুল জানান, আপনারা সকলেই বাদলের ন্যায়বিচারের জন্য এই পিটিশনে স্বাক্ষর করুন যাতে ভারতের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফিরতে পারে। 

বাদলকে নিয়ে ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর দ্য ইন্ডিয়ান ইক্সপ্রেসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।  সেখানেও তার নিরপরাধের বিষয় তথ্য প্রমাণসহ প্রকাশিত হয়। রাহুল জানান, আমি বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছ থেকে প্রাপ্ত সমস্ত নথি, সংবাদপত্রে প্রকাশিত সেই পেপার কাটিং সমস্তটাই পিটিশনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।  ইতিমধ্যেই ‘জাস্টিস ফর বাদল’-শীর্ষক ওই পিটিশনে বাদলের মুক্তি চেয়ে ২৬১ জন স্বাক্ষর করেছেন।  ৫০০ জনের স্বাক্ষর করা ওই পিটিশন জমা দেওয়া হবে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। 

কিন্তু বাদল ফরাজি’কে দেখে মনে হওয়ার উপায় নেই যে গত কয়েকবছরে তার ওপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে গেছে।  তিনি জানিয়েছেন ‘২০১০ সালে ‘পড়ো পড়াও’ নামে একটি ক্লাস শুরু হয়।  সেই থেকে এখনও পর্যন্ত ওই শিক্ষার সাথে জড়িয়ে রয়েছি।  আমি ইতিমধ্যেই ৮টি ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করেছি।  তিনি জানান, জীবনের যে দিনগুলি চলে গেছে তা আর ফিরে আসার নয়, এখন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে’।

বিডি প্রতিদিন/২৩ জানুয়ারি, ২০১৮/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর