১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০৮:৪৩

দুই জঙ্গি বোনের কাহিনী

সাখাওয়াত কাওসার

দুই জঙ্গি বোনের কাহিনী

প্রতীকী ছবি

নব্য জেএমবির সদস্য এবং সিরিয়া ফেরত প্রকৌশলী গাজী কামরুস সালাম সোহান ওরফে গাজী সোহানের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদে হাতেখড়ি হয় অস্ট্রেলিয়া পুলিশের হাতে আটক মোমেনা সোমার। গাজী সুমনই তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় সিরিয়াগামী পথভ্রষ্ট আরেক যুবক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নজিবুল্লাহ আনসারীর সঙ্গে। তবে সিরিয়ায় গিয়ে আইএস জঙ্গিদের নিষ্ঠুরতা দেখে সোহান পালিয়ে দেশে এসে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করলেও বদলাননি সোমা। উল্টো সহোদর আসমাউল হুসনা ওরফে সুমনাকে জঙ্গিবাদে দীক্ষা দিয়েছেন। নিজে অস্ট্রেলিয়া গেলেও দেশে নিজেদের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটি) কাছে পাঁচ দিনের রিমান্ডে থাকা ছোট বোন সুমনার কাছ থেকে এমনটাই তথ্য আদায় করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গতকাল তার রিমান্ডের চতুর্থ দিন শেষ হয়েছে। সিটি সূত্র বলছে, ২০১৩ সালের শুরুতে গাজী সোহানের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সোমা। সে সময় সে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ত। শুরুতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে হলেও পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন স্থানে দেখা করে। পরবর্তীতে গাজী সোহানের মাধ্যমে নজিবুল্লাহ আনসারীর সঙ্গে পরিচয় হয় সোমার। একপর্যায়ে আনসারী ও সোমার মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই সময় ঢাকার পূর্ব কাজিপাড়ার ৩৫৫/১ নম্বর রয়েল অ্যারোমা গার্ডেনে নিজেদের ফ্ল্যাটেও নজিবুল্লাহ আনসারীকে নিয়ে গিয়েছিল সোমা। তবে তাদের ওই সম্পর্ককে মেনে নেয়নি সোমার পরিবার। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি আনসারী সিরিয়া চলে যাওয়ায় তাদের আর বিয়ে হয়নি। পরবর্তীতে সোমাও সিরিয়ায় যেতে চেয়েছিল। সে জন্য সে তুরস্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করে। তবে দূতাবাস তাকে ভিসা না দেওয়ায় সোমা যেতে পারেনি। অন্যদিকে, আনসারী জীবিত নাকি মারা গেছেন তাও নিশ্চিত নন গোয়েন্দারা। গতকাল সরেজমিনে পূর্ব কাজিপাড়ার ৩৫৫/১ নম্বর বাড়িতে গিয়ে সোমা-সুমনার বাবা মনিরুজ্জামানের খোঁজ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ১০ তলা ওই ভবনের ৮ম তলার একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করেন এই পরিবার। ভবনের কেয়ারটেকার মতিউর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, পুলিশ আসার পর থেকেই মনিরুজ্জামান সাহেব বাসায় থাকছেন না। তিনি বর্তমানে তার ভাইয়ের বাসায় থাকেন। মাঝখানে একদিন এসেছিলেন। তখন দেখেছি তিনি অসুস্থ। কিছু কাগজপত্র নিয়ে কিছু সময় পরেই তিনি চলে যান। কয়েকদফায় তার ফোনে কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।

এক সময় সোমা-সুমনার পরিবারের গাড়ি চালাতেন মাইনুল ইসলাম রাজু নামের এক ব্যক্তি। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে রাজু উবারের গাড়ি চালান। গতকাল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় রাজুর। তিনি বলেন, তার বোন তাকে একটি গাড়ি কিনে দেওয়ায় এক মাস আগে তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার এক-দেড় বছর পর সোমার মাঝে পরিবর্তন আসে। হিজাব পরা শুরু করেন তিনি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় মাস পড়াশোনা করেছেন।

সূত্র আরও জানায়, দুই বছর আগে ছোট বোন সুমনাকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে সোমা। ২০১৬ সালে সম্মান শ্রেণি সম্পন্ন করার আগে মোমেনা সোমার সঙ্গে অনেকের যোগাযোগ ছিল। এদের মধ্যে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় অংশ নিয়ে নিহত নিবরাস ইসলাম ও রোহান ইমতিয়াজ অর্ক অন্যতম। রিমান্ডে থাকা ছোট বোন সুমনা বলেছে, সে তার বড় বোনের (সোমা) কাছে নিবরাস ও রোহানের নাম শুনেছে। তবে তার সঙ্গে নিবরাস ও রোহানের সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, দুই বোনের অস্ট্রেলিয়া এবং ঢাকায় হামলার চেষ্টা পূর্ব পরিকল্পিত কিনা তা আমরা এখনো নিশ্চিত নই। জঙ্গিবাদে দুই বোনের জড়িত হওয়ার বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করছি। সূত্র জানায়, মোমেনা সোমা ২০০৯ সালে ঢাকার লরেটো স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল, ২০১১ সালে মাস্টারমাইন্ড স্কুল থেকে ‘এ’ লেভেল সম্পন্ন করে। এরপর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করে। সেখানে পড়ার সময়ই তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়। প্রথম দিকে পশ্চিমা পোশাক পরলেও হঠাৎ করেই ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে কট্টরভাবে ইসলামিক নিয়ম মেনে চলতে দেখা যায় তাকে। যদিও আহলে হাদিসের অনুসারী পরিবারের অন্য সদস্যদের এ বিষয়টি অবাক করেনি। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে সুমনা মিরপুরের গার্লস আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। এরপর এইচএসসিতে ভর্তি হয় গ্রিনফিল্ড স্কুলে। তবে ২০১৬ সালে সে পরীক্ষায় ফেল করার পর মেন্টর’স থেকে জিইডি সম্পন্ন করে। স্কলারশিপ নিয়ে মালয়েশিয়ার একটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ  পেলেও হেপাটাইটিস-বি থাকায় স্বাস্থ্য পরীক্ষায় বাদ পড়ে যায় সে। পরবর্তীতে গত বছরের অক্টোবরে ধানমন্ডিতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয় সুমনা। সোমা ও সুমনা ঢাকার কিছু জায়গায় নারীদের নিয়ে ‘হালাকা’য় মিলিত হতো। হালাকা অর্থ কয়েকজন মিলে আলোচনা করা। সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে রাজধানীর একটি এলাকার মসজিদে গিয়ে সোমার হালাকা করার কিছু তথ্য পেয়েছেন তারা। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে সুমনা জানিয়েছে, দুই বোন মিলে তারা জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলত। অনলাইনে জিহাদি বিভিন্ন ভিডিও দেখত। বড় বোন মোমেনা সোমা তাকে ছুরি চালানোর প্রাথমিক প্রশিক্ষণও দিয়েছিল। এমনকি সোমা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে বলেছে, সে ওখানে কোনো একটি হামলা চালাবে। এরপর ঢাকার বাসায় পুলিশ তার খোঁজ করতে এলে তাদের ওপরে হামলা করার জন্য সুমনাকে বলে গিয়েছিল সে। প্রসঙ্গত, গত ৯ ফেব্রুয়ারি মেলবোর্নে একজন ব্যক্তিকে ছুরিকাহত করার অভিযোগে বাংলাদেশি মোমেনা সোমাকে (২৪) অস্ট্রেলিয়া পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা গত রবিবার তাদের পূর্ব কাজীপাড়ার বাসায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সুমনা এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত করে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর