১৬ জানুয়ারি, ২০১৯ ০৯:১৩

বিএনপি এখন কার

খালেদা জিয়া জেলে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে, জোট ঐক্যফ্রন্টে টানাপড়েন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপি এখন কার

বিএনপি এখন কার? একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে করুণ পরাজয়ের পর দলটি ভোট বাতিল ও পুনর্নির্বাচন দাবি করে এলেও এ প্রশ্নটি বড় হয়ে এসেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে চলবে নাকি কারাবন্দী দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পরামর্শে দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে? নাকি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্ব ঘিরে দল চলবে অথবা লন্ডনে নির্বাসিত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে চলবে বিএনপি? নেতৃত্বহীন বিএনপি নেতা-কর্মীদের সামনে এখন এটাই বড় প্রশ্ন।

প্রায় এক বছর ধরে কারাগারে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সুদূর লন্ডনে অবস্থান করছেন। জামায়াত ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের তীর্যক মন্তব্যে অস্বস্তিতে বিএনপি। এ নিয়ে ২০-দলীয় জোট ও ফ্রন্টে চলছে টানাপড়েন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই এখন বিএনপির স্থায়ী কমিটি নিতে পারছে না। আটকে যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও জোটের বৈঠকে। এ মুহূর্তে বিএনপির নেতৃত্ব এখন কার হাতে তাও স্পষ্ট নয়। দলের নেতৃত্ব কীভাবে চলছে-তা নিয়ে প্রশ্ন মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদেরও। যদিও বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির দিকনির্দেশনার ভিত্তিতেই দল পরিচালিত হওয়ার রীতি রয়েছে। জানা যায়, প্রার্থী বাছাইয়ে পর্যাপ্ত হোমওয়ার্ক ছাড়াই সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি। ভোট নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও কেন্দ্রে এজেন্ট ধরে রাখার মতো সাংগঠনিক শক্তি বিএনপির অধিকাংশ আসনেই ছিল না। কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার কথা বললেও নেতারা আগের দিনই ভোটের মাঠ ছেড়ে দেন। যুবদল, ছাত্রদলসহ বিএনপির কোনো অঙ্গসংগঠনকেই মাঠে দেখা যায়নি। অধিকাংশ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা পর্যন্ত করা হয়নি। যেসব স্থানে যোগ্য প্রার্থী ও সংগঠন ছিল সেখানে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে নেতা-কর্মীরা। কোনো কোনো সংসদীয় আসনে পোস্টার সাঁটানোর চেষ্টাও করেননি প্রার্থী। কোনো অর্থ ব্যয় না করার অভিযোগও আছে বেশ কিছু প্রার্থীর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে একদিকে জামায়াতসহ ২০ দল অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আসন ভাগাভাগি নিয়েও ভোটের শেষ দিকে খেই হারিয়ে ফেলে বিএনপি। এ কারণে জোট ও ফ্রন্টের মন রক্ষায় অনেক অযোগ্য প্রার্থীর হাতেও ধানের শীষ তুলে দিতে হয়েছে। জানা যায়, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি এখন কোনো সিদ্ধান্ত নিলেই তা বাস্তবায়িত হয় না। এমনকি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কোনো পরামর্শ দিলেও তা আটকে যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে। বিএনপির কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কখনো কখনো জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে আবার কখনো কখনো ২০ দল থেকেও বাধা আসে। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয়, জামায়াতকে স্বতন্ত্র প্রতীকে ভোটে অংশ নিতে হবে। কিন্তু জামায়াত বেঁকে বসায় শেষ পর্যন্ত ২২টি আসনে জামায়াতের হাতে ধানের শীষ তুলে দেওয়া হয়।

এ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বিএনপির ওপর চরম ক্ষুব্ধ। ভোটে ভরাডুবির পর কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বলেছেন, শপথ না নিতে, সংসদে না যেতে। দলের মাঠপর্যায়ের অধিকাংশ নেতা-কর্মীও তাই চান। কিন্তু গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজন নেতা গুটিকয়েক এমপিকে নিয়েই সংসদে যাওয়ার পক্ষে। এ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির স্নায়ু যুদ্ধ চলছে। শেষ মুহূর্তে বিএনপি ফ্রন্টের আটজন সংসদ সদস্য শপথ নিয়ে পার্লামেন্টে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দল, জোট ও ফ্রন্টকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই বিএনপির সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে জামায়াত ইস্যুতে জোট ও ফ্রন্টে নতুন করে প্রশ্ন ওঠছে। জোটে জামায়াতকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে প্রকাশ্যেই মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত ভোটে জামায়াতের হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। তিনি গণমাধ্যমকে প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘জামায়াতকে ধানের শীষ তুলে দেওয়া হবে জানলে ঐক্যফ্রন্টেই থাকতাম না।’ এ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সামনের পাঁচ বছর আন্দোলন সংগ্রামে জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি কীভাবে পথ চলবে তাও স্পষ্ট নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে যে কোনো মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও ভেঙে যেতে পারে। তবে বিএনপির একটি সূত্র জানায়, যাই হোক এ মুহূর্তে জামায়াতকে ছাড়বে না বিএনপি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আসলে বিএনপির নেতৃত্ব এখন কার হাতে তা স্পষ্ট নয়। কারণ, ভোটের পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজের মতো করেই মাঠপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এরই মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান, সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে স্কাইপিতে কথা বলেছেন তিনি। যুবদল ও ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন তারেক রহমান। তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে দেশের বর্তমান অবস্থায় করণীয় নিয়ে দীর্ঘ কথা বলেন এবং তাদের মতামত নেন। কিন্তু সেখানে কোনো সিনিয়র নেতাদের রাখা হয়নি। স্থায়ী কমিটির বৈঠকও হচ্ছে যথারীতি। গতকাল বিকালেও গুলশানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডন থেকে স্কাইপিতে অংশ নেন তারেক রহমান। বৈঠকে অধিকাংশ নেতাই কথা বলেননি।

এ দিকে ভোটের ঠিক আগমুহূর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও একজন ভাইস চেয়ারম্যানের টেলিফোন আলাপ ফাঁস হয়। এ নিয়ে নেতা-কর্মীরা বিভ্রান্তিতে পড়ে। তবে ফোনালাপেও বিএনপির নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায়। শীর্ষপর্যায়ের এক নেতাকে নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে দুই নেতার মন্তব্য ছিল তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বক্তব্যেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনরক্ষার স্বার্থে শেষ পর্যন্ত ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনে অবস্থান কর্মসূচি থেকে সরে আসেন বিএনপির হাইকমান্ড। এ নিয়ে নেতারা পরস্পরকে দোষারোপ করলেও ঐক্যফ্রন্টের অনীহার কারণেই এ কর্মসূচি দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মতে, বিএনপি চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে দলে ‘চেইন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনতে হবে। লন্ডনে অবস্থান নেওয়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পরামর্শ নিতে হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। এমনকি বিএনপির জেলা কমিটি, অঙ্গসংগঠনের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের সব কমিটি ঢেলে সাজাতে হবে। ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, জেলা, মহানগরসহ কেন্দ্রীয় সব কমিটি নির্বাচিত হতে হবে। এ নিয়ে দ্রুত কাউন্সিলও ডাকা যেতে পারে। নির্বাচনের মাধ্যমে দল পুনর্গঠন করে সামনে পথ চলতে হবে।

জানা যায়, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামত নিয়ে নির্বাচিত কমিটি দিয়েই দল পরিচালনা করতে চান তারেক রহমান। এ নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলবেন তিনি। বিশেষ করে ছাত্রদল, যুবদলসহ অঙ্গসংগঠনের কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটি গঠন করার চিন্তাভাবনা করছেন তারেক রহমান।

জোট ফ্রন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর উপজেলা ভোট নিয়ে সিদ্ধান্ত : আসন্ন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের আগে ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের মতামত জানবে বিএনপি। এ জন্য শিগগিরই এ দুটি জোটের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। রাত ৭টায় এই বৈঠক শুরু হয়ে চলে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। এ ছাড়া নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে শিগগিরই ধানের শীষের প্রার্থীরা মামলা করবেন। এ জন্য সব তথ্য-প্রমাণ প্রস্তুত রাখার জন্য প্রার্থীদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা করেন নীতিনির্ধারকরা। সূত্র জানায়, বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বৈঠকে আগামী ১৯ জানুয়ারি দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে কর্মসূচির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দলের প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিন উপলক্ষে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে অন্তত সাত থেকে আট দিনের কর্মসূচি নেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর