২০ মার্চ, ২০১৯ ০৯:৪০
বেঁচে আসা ইয়াসমিনের বর্ণনা

ব্রাশফায়ার ব্রাশফায়ার!

নিজামুল হক বিপুল

ব্রাশফায়ার ব্রাশফায়ার!

নির্বাচনী সরঞ্জামে লেগে আছে রক্ত -বাংলাদেশ প্রতিদিন

‘ভাই আপনাকে ঘটনাটা বর্ণনা করে বোঝাতে পারব না। হঠাৎ টাস টাস শব্দ। যেন টিনের ঘরের চালে বড় বড় শিল পড়ার শব্দ শুনছিলাম। সঙ্গে থাকা পুলিশ ভাইয়েরা বললেন ব্রাশফায়ার ব্রাশফায়ার, এ কথা শুনে আমরা যারা গাড়ির ভিতরে ছিলাম তারা সবাই সঙ্গে সঙ্গে একজনের ওপর আরেকজন শুয়ে পড়লাম। এর মধ্যেই প্রাণ নিয়ে আমাদের বহনকারী গাড়ি দ্রুত ছুটে চলছিল।’

বাঘাইছড়ির নয়মাইল এলাকায় সোমবার সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ থেকে সুস্থভাবে বেঁচে আসা স্কুল শিক্ষিকা ইয়াসমিন আক্তার এভাবেই বর্ণনা করছিলেন সেই রাতের ঘটনা।

গতকাল বিকালে ঢাকা থেকে ইয়াসমিনের সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন এ প্রতিবেদককে।

ইয়াসমীন বলছিলেন, এখনো আমার পুরো শরীর থর থর করে কাঁপছে। একেবারে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। মৃত্যুকে চোখে দেখে এসেছি। কীভাবে যে বেঁচে আছি বোঝাতে পারব না। বাসায় ফিরে স্বামী, দুই সন্তানসহ সবাইকে জড়িয়ে ধরে শুধু কান্না করেছি।

তিনি বলেন, এখনো ভয়, আতঙ্ক আমাকে তাড়া করে ফিরছে। কোনো কিছু খেতে পারছি না। চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যেই এতগুলো মানুষ মারা গেলেন।

কীভাবে ঘটেছিল এ লোমহর্ষক ঘটনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ইয়াসমিন বলেন, আমি ছিলাম বাঘাইহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। ভোটগ্রহণ শেষ করে ভোটের সরঞ্জাম নিয়ে আমরা যারা এ কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেছি, প্রায় ২৫-২৬ জন সবাই একসঙ্গে একটি চান্দের গাড়িতে করে বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরের উদ্দেশে রওনা হই। আগে থেকেই আমাদের জন্য আরও দুটি গাড়িতে কংলাক ও মাচালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা সবাই অপেক্ষা করছিলেন বাঘাইহাটে। আমাদের তিনটি গাড়ি ও বিজিবির একটি গাড়ি একসঙ্গে রওনা হওয়ার পর প্রায় আধাঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে পৌনে ৭টার দিকে নয় মাইল বটতলা এলাকায় পৌঁছতেই পাহাড়ের ওপর থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসতে থাকে আমাদের গাড়িগুলো লক্ষ্য করে। সবার সামনে ছিল বিজিবির গাড়ি, তারপরই আমাদের গাড়ি। পেছনে আরও দুটি গাড়ি। গাড়ির ভিতরে যারা ছিলাম তারা শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু গাড়ির ছাদে যারা ছিলেন তাদের অনেকের মৃত্যু ঘটেছে।

ইয়াসমীন বলেন, এমনিতেই ভয়ে ছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারপাশ অন্ধকায় হয়েছে। কখন উপজেলা সদরে যাব, কখন বাসায় যাব- এ নিয়েই ভয় ছিল। কিন্তু সেই ভয় যে এভাবে মৃত্যুতে রূপ নেবে সেটা আমরা কেউই ভাবিনি। এ স্কুল শিক্ষিকা বলেন, গুলির শব্ধ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামনে থাকা বিজিবির গাড়ি ইশারা করছিল দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর। চালকও নিজের জীবন বাজি রেখে খুব জোরে গাড়ি টানছিল। কোথাও থামেনি। যার ফলে আমরা অনেকেই মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছি। তারপরও আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তায় নয় মাইল বটতলা এলাকা অতিক্রম করার সময় প্রায় ১০ মিনিট ধরে আমি গুলিবর্ষণের শব্দ শুনতে পেয়েছি। তিনটি গাড়িই সোজা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায়। সেখানে যাওয়ার পর পরই আমরা দেখতে পাই আমাদের সহকর্মীদের লাশ। অনেকে গুলিবিদ্ধ। আমরা যারা সুস্থ ছিলাম, প্রাণে বেঁচে গেছি তাদের স্বজনরা আগে থেকেই হাসপাতালে ভিড় করছিলেন। তারা আমাদের বাসায় নিয়ে যান। স্কুল শিক্ষিকা ইয়াসমিন দুই সন্তানের জননী। তার বড় মেয়ে আট বছরের আরীশা এবং ছেলে তিন বছরের ইয়াসির। তার স্বামী খুরশেদ আলম বাঘাইছড়ি বাজারে মুদির দোকানি। ইয়াসমিন জানান, তার মতো তার আরেক সহকর্মী বর্ডারগার্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা শেলীনা বেগমও একেবারে ভেঙে পাড়েছেন। তিনিও গতকাল বাসা থেকে বের হননি।

বিডি প্রতিদিন/কালাম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর