জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে নজিরবিহীন হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনার পর সচিবালয়ে গতকাল দিনভর আলোচনা ছিল ‘ডিসি ইস্যু’। তবে সুনসান নীরবতা ছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করার ঘটনা ছিল সব আলোচনার কেন্দ্রে; যা ‘হট টপিক’ হিসেবে সিনিয়র-জুনিয়র কর্মকর্তারা নানামুখী বিশ্লেষণ করছেন। এদিকে নতুন নিয়োগ পাওয়া ডিসিরা ইতোমধ্যে কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন।
গতকাল সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তার রুমে গেলে ডিসি নিয়োগ আর হট্টগোলের আলোচনাই শোনা যায়। তথ্য, খাদ্য, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের বিশৃঙ্খলার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করেন। এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘ডিসি হতে পারলাম না, তাই মারামারি করব, বিষয়টা কেমন দেখায়?’ তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছি। আমরা একটা শৃঙ্খলার মধ্যে থাকি সেখানে এসব মানা যায় না।’ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিব বলেন, ‘যারা এসব করল তাতে আমাদের বিষয়ে একটা খারাপ মেসেজ গেল সাধারণ মানুষের কাছে। আমরা মারামারি করে কোনো পদ নিতে পারি না। শৃঙ্খলা বলে যে বিষয়টি আছে সেটি অনেকের মাথায় কাজ করেনি ওই সময়।’ এ সময় নানা আলোচনা-সমালোচনাার পাশাপাশি ডিসি হওয়া কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ভালো কাজ, খারাপ কাজ নিয়েও কথা বলেন অনেকে।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডিসি নিয়োগে এমন ঘটনা খুবই ন্যক্কারজনক, যা আগে কখনোই ঘটেনি। এসব মোটেই কাম্য নয়। সচিবালয়ে এমন বিশৃঙ্খলার খবর সারা দেশে ভালো বার্তা দেয় না। সবারই এসব বিষয়ে আরও সতর্ক থাকা উচিত।’ এদিকে গতকাল সচিবালয়জুড়ে নানা আলোচনা থাকলেও খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ঘুরে একাধিক ফ্লোরে শুনসান নীরবতা দেখা যায়। এ সময় ডিসি হতে না পারা কয়েকজন কর্মকর্তার আনাগোনা থাকলেও সে সংখ্যা ছিল কম। বিভিন্ন রুমে উপস্থিত কর্মকর্তার সংখ্যাও ছিল কম। এর আগে মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ডিসি নিয়োগ নিয়ে দিনভর হট্টগোল হয়। ডিসি হতে না পেরে নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে কর্মকর্তারা মাঠ প্রশাসন শাখার যুগ্মসচিব কে এম আলী আযমের রুম ঘেরাও করেন। ওই কর্মকর্তা ২ ঘণ্টা ওয়াশরুমে অবরুদ্ধ ছিলেন। এর পরদিন বুধবারও বেশ সরগরম ছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেরও অনেকের দৌড়ঝাঁপ ছিল। তবে শেষ কর্মদিবসে গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ছিল অনেকটাই ফাঁকা। মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় তলায় সুনসান নীরবতা দেখা যায়। মাঠ প্রশাসন শাখার যুগ্মসচিব কে এম আলী আযম এবং ঊর্ধ্বতন নিয়োগ অধিশাখার যুগ্মসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ গতকাল অফিস করেননি। আশপাশে একাধিক শাখার অনেকের রুম ফাঁকা দেখা যায়। তবে নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের দেখা গেলেও লোকজন অন্য দিনের চেয়ে কম ছিল। দুপুরের দিকে হাতেগোনা কয়েকজন কর্মকর্তা ডিসি হওয়ার দাবিতে শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. বাবুল মিঞার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় নিজেদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন ডিসি হতে না পারা এসব কর্মকর্তা। পরে সন্ধ্যায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর রুমে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহর সঙ্গে বৈঠক করেন ডিসি পদপ্রত্যাশীরা। ওই বৈঠকে ডিসি হতে না পারা একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের প্রায় ৩০-৪০ জন যারা উপস্থিত ছিলাম তারা সার্বিক বিষয় জানিয়েছি। সভাপতি আমাদের বিভিন্ন বিষয় শুনলেন।’ পরবর্তী করণীয় কী-এ নিয়ে জানতে চাইলে ডিসি পদপ্রত্যাশী এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জনপ্রশাসন সচিব স্যার অফিসে অল্প সময় ছিলেন। ফলে আমরা দেখা করতে পারিনি। ক্যাবিনেট সচিব এবং জনপ্রশাসন সচিব আমাদের আশস্ত করেছেন। তাই আমরা পরবর্তী কর্মদিবসে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইব।’ ডিসি পদে নিয়োগবঞ্চিতদের হট্টগোল একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা উল্লেখ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বিষয়টিকে বিশৃঙ্খলা ও অশোভন আচরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইতোমধ্যে হট্টগোলের ঘটনায় কারণ জানতে এক সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তী সরকার দুই দিনে মোট ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিলে বিতর্ক তৈরি হয়। কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের মুখে নতুন ৫৯ জন ডিসির মধ্যে নয়জনের নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। নতুন নিয়োগ পাওয়া ডিসিরা সরকারের নির্দেশনা মেনে গতকালই যোগদান করেছেন স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে। একাধিক ডিসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বুধবার রাতেই আমাদের কর্মস্থলের উদ্দেশে যেতে বলেন যেন বৃহস্পতিবারই আমরা কর্মস্থলে যোগ দিতে পারি। আমরা মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনা মেনে বেশির ভাগ কর্মকর্তা রাতেই কর্মস্থলের উদ্দেশে যাত্রা করেছি এবং বৃহস্পতিবার দায়িত্ব বুঝে নিয়ে অফিস করেছি।’ আশপাশ জেলার কেউ কেউ সকালে যাত্রা করে ৯টার মধ্যে অফিসে হাজির হয়েছেন এবং দায়িত্ব বুঝে নেন বলেও জানা গেছে। ২৪ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম, ২৫তম ও ২৭তম ব্যাচের ৬১৭ জন উপসচিবের সাক্ষাৎকার নেয় ডিসি ফিটলিস্ট প্রণয়ন কমিটি। সাক্ষাৎকার শেষে নতুন ডিসি ফিটলিস্টে যুক্ত করা হয়েছে ১০৬ কর্মকর্তাকে। সেখান থেকেই ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়।
আইসিটি ও তথ্য সচিব ওএসডি: তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিনকে ওএসডি করা হয়েছে। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কিত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তবে নতুন করে সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এদিকে গতকাল দুই বছরের জন্য সিনিয়র সচিব মর্যাদায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন আশিক চৌধুরী।