‘আমরা এখানে আটকা পড়েছি। যত দিন যাচ্ছে, ততই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপদ হয়ে যেতে পারে। আমরা দ্রুত দেশে ফিরতে চাই। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, আমাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।’
গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমের কাছে এভাবেই দেশে ফেরার আকুতি জানান লেবাননপ্রবাসী বাংলাদেশি ইমরান হোসেন।
ইমরান হোসেন গত জানুয়ারি মাসে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে। আর্থিক সচ্ছলতার যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি বৈরুতে গিয়েছিলেন তা পূরণের বদলে এখন আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে তাঁকে। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সেখানে অবস্থানের বদলে দেশে ফেরাকেই ভালো মনে করছেন তিনি।
ভুক্তভোগীরা জানান, লেবাননে ক্রমবর্ধমান ইসরায়েলি হামলার মুখে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন দক্ষিণ লেবাননে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা। হামলার তীব্রতা বাড়ছে বৈরুতেও। জীবন বাঁচাতে অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে চলে গেছেন অন্য কোনো শহরে।
জানা যায়, লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় গত সোমবার পর্যন্ত তিনজন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন। আহতদের মধ্যে দু’জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমরা এখানে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছি। খোলা আকাশের নিচে দিন যাপন করছি। গত রবিবার রাত ১টায় রাজধানীতে তিনটি বোমা হামলা করা হয়েছে। আমরা সব সময় ভয় ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি।’
শুধু ইমরান হোসেন নন, তাঁর মতো আরো কয়েক হাজার বাংলাদেশি এখন লেবানন থেকে দেশে ফিরে আসার আকুতি জানাচ্ছেন। বগুড়ার বাসিন্দা মাইনুদ্দিন মুঈন তাঁদের একজন।
মুঈন বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ইসরায়েলি জঙ্গি বিমান বোমা নিক্ষেপ করছে। আমরা বেশির ভাগ প্রবাসী দক্ষিণ লেবাননে বসবাস করি। এখানে কয়েক হাজার বাংলাদেশি বসবাস করে। এই অঞ্চলেই বোমা নিক্ষেপ বেশি করা হচ্ছে।’
লেবাননপ্রবাসী আরেক বাংলাদেশি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুরো রাজধানীতে সুনসান নীরবতা। গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। রাস্তাঘাটও ফাঁকা। অনেক বাংলাদেশি লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এসে বৈরুতে আশ্রয় নিয়েছেন। নানা কারণে অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে এখনো যেতে পারেননি। অনেক বাংলাদেশি দেশে ফিরতে চাইছেন, কিন্তু সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না।’
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে লেবাননে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছিল। ২০২৩ সালে দেশটিতে কর্মী ভিসায় দুই হাজার ৫৯৪ জন পাড়ি দিয়েছিলেন, যার মধ্যে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গেছেন এক হাজার ৮৭০ জন কর্মী। সে তুলনায় চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত লেবানন পাড়ি জমিয়েছেন চার হাজার ২২৫ জন কর্মী।
অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, লেবাননে নিরাপত্তার শঙ্কা না থাকলে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা আরো বাড়ত।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে বিমান হামলার পর বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি গত কয়েক দিনে বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাসের সূত্র জানায়, লেবাননের যেসব জায়গায় ইসরায়েল হামলা করছে সেসব জায়গা থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দূতাবাস এবং স্থানীয় বাংলাদেশ কমিউনিটি সহযোগিতা করছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত, কর্মকর্তা ও স্টাফ মিলিয়ে সাত-আটজন রয়েছেন। বৈরুতে তাঁদের পরিবারসহ সংখ্যাটি ১৫ হবে। রাষ্ট্রদূতসহ দূতাবাসের সব কর্মী এবং তাঁদের পরিবারকে বৈরুত শহরের আশপাশে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বৈরুতে দুই হাজারের মতো বাংলাদেশি রয়েছে। বৈরুতসহ লেবাননের যেসব এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটেছে, সেসব এলাকা থেকে তাঁদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈরুতের উত্তরে অথবা অন্য কোনো নিরাপদ এলাকায় অবস্থান নিতে বলা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত এক সপ্তাহ দক্ষিণ বৈরুতের কিছু এলাকায় ক্রমাগত বিমান আক্রমণ চালানো হচ্ছে। আক্রমণের ধারায় প্রতীয়মান হয় যে দাহি ও এর নিকটবর্তী এলাকায় বসবাস করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমন অবস্থায় যেসব বাংলাদেশি এখনো ওই এলাকায় অথবা এর অতি নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করছেন, তাঁদের অতিসত্বর ওই এলাকা ত্যাগ করে বৈরুতের উত্তরে অথবা অন্য কোনো নিরাপদ এলাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো।
বিজ্ঞপ্তিতে জরুরি প্রয়োজনে দূতাবাসের ফ্রন্ট ডেস্ক (৭১২১৭১৩৯), হটলাইন (৭০৬৩৫২৭৮) কিংবা হেল্পলাইন (৮১৭৪৪২০৭) নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর বৈরুতের স্থানীয় সময় গত শনিবার লেবাননে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এয়ার ভাইস মার্শাল জাভেদ তানভীর খান এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুগ্রহ করে আপনার নিজ নিজ অবস্থানে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করুন। আপনি যদি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হন আমাদের দ্রুত জানান।’
সূত্র : কালের কণ্ঠ
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত