চাল, শাকসবজি, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বাজার বিশ্লেষকরা পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় সময়মতো পদক্ষেপ নিতে না পারার সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, সিন্ডিকেটগুলো পরিস্থিতির সুবিধা নিয়ে ভোক্তাদের ওপর আরও বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। চাল, শাক-সবজি, ডিম এবং ব্রয়লার মুরগির দাম গত এক মাসে অস্বাভাবিক বেড়েছে। অন্যান্য পণ্যের দামও ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।
এ বিষয়ে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার পণ্য বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আগের সরকারের আমলারাই রয়ে গেছে এবং ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ আছে। তাই নিত্যপণ্যের দাম কমছে না। তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর পণ্যের দাম কমেছিল। কয়েকদিন পর সিন্ডিকেট দেখল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, আবার দাম বেড়ে গেল। আবার অনেক পণ্য আমদানি করা হচ্ছে তারপরও দাম কমছে না সিন্ডিকেটের কারণে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ডিম আমদানির খবরেই দাম কমে গেছে। মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠিয়ে সারা দেশে দাম ঠিক করে দেয় সিন্ডিকেট। তাই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার ও সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য সরকার সম্প্রতি জেলা পর্যায়ে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এর আগেও সরকার চিনি, আলু এবং পিঁয়াজের আমদানি শুল্ক হ্রাস করলেও বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। গতকাল আবারও কমানো হয়েছে চিনির শুল্ক। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির অর্থনীতির অধ্যাপক গোলাম রসুল সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষ খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে শ্রমজীবী মানুষ প্রায়ই পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হয়, যা মানব পুঁজির উন্নয়নে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
খুচরা বিক্রেতাদের মতে, গত দুই মাসে চালের দাম কেজিতে ৬-৮ টাকা বেড়েছে। একই সময়ে মুরগির দাম কেজিতে ৩০-৪০ টাকা বেড়েছে। গত এক মাস ধরে পাইকারি বাজারে প্রায় প্রতিদিনই ডিমের দাম বাড়ছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা আবজাল হোসেন জানান, গত দুই মাসে ৫০ কেজি চালের দাম বস্তা প্রতি ২০০ টাকা বেড়েছে। পাইকার ও মিলাররা চালের দাম বাড়ার অজুহাতে ধানের দাম বাড়িয়েছে। রাজধানীর বাজারে মাঝারি চাল বিক্রি হয় ৫৮ থেকে ৬২ টাকা কেজিতে। নিম্নমানের মিনিকেট ৬৫-৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। গতকাল মিনিকেটের (চিকন) প্রতি কেজি ৭৬-৮০ টাকায় এবং নাজিরশাইল ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে ডিম এবং ব্রয়লার মুরগির যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও এক দিনের জন্যও এই পণ্যগুলো সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রি হয়নি।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রতিটি ডিমের দাম ১১.৮৭ টাকা, ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭৯.৫৯ টাকা এবং সোনালিকা মুরগি ২৬৯.৬৪ টাকা কেজি নির্ধারণ করে। যদিও ঘোষণার পর থেকে গত তিন সপ্তাহে ডিমের দাম হালিতে ৭-৮ টাকা বেড়েছে। গতকালও রাজধানীর বাজারে ডিমের হালি বিক্রি হয়েছে ৫৮-৬০ টাকায়। ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ব্রয়লার মুরগির কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২০০-২১০ টাকা কেজি। সোনালিকা মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৮০-২৯০ টাকা কেজি। ডিমের বাজারে অস্থিরতার প্রতিক্রিয়ায় গত মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। ট্যারিফ কমিশন ওইদিন আবারও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে স্থানীয় বাজারে ডিমের উচ্চমূল্য রোধে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে।
পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে টিসিবি রাজস্ব বোর্ডকে জানিয়েছে, গত মাসে ডিমের দাম ১৫ শতাংশ এবং গত বছরের তুলনায় ২০.৪১ শতাংশ বেড়েছে। এর আগে গত ২৯ আগস্ট ডিম আমদানির শুল্ক কমানোর বিষয়ে রাজস্ব বোর্ডকে সুপারিশ করে ট্যারিফ কমিশন। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা ডিমের দামে অস্থিতিশীলতার জন্য খামারি এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন। গত এক মাসে সবজির দাম নাটকীয়ভাবে বেড়েছে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রাকে ক্রমশ কঠিন করে তুলেছে। বেশির ভাগ সবজির কেজি ৮০ থেকে ১২০ টাকা। প্রতি কেজি পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকায়। কাঁচা মরিচ বিক্রি হয় ৩৮০-৪০০ টাকা কেজি। কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এমরান মাস্টার বলেন, সারা দেশে বন্যা ও বর্ষণে কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সরবরাহ ঘাটতির কারণে সবজির দাম বেড়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে সবজির সরবরাহ প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ