দেশের অর্থঋণ আদালতগুলোতে খেলাপি ঋণের ২০ হাজারের বেশি মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলে রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়ায় বিপদে পড়ছেন ঋণগ্রহীতারা। আবার ব্যাংকগুলোও আদায় করতে পারছেন না ঋণের টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চাহিদার তুলনায় দেশে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম। আদালতগুলোর বিচারকসংখ্যাও যথেষ্ট নয়। নানা কারণে অর্থঋণ আদালতের মামলাজট তৈরি হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়রানিও বাড়ছে। মামলা ঝুলে থাকায় গ্রাহকরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা দ্রুত নিষ্পিত্তিতে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষই অনীহা দেখায়। কোনো মামলায় বাদী আগ্রহী হলে বিবাদীর অনাগ্রহ থাকে। আবার কোনোটিতে বিবাদী মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি চাইলে বাদী সময় আবেদন করে কালক্ষেপণ করেন। এতে করে মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণখেলাপির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ দেশের অভ্যন্তরেও নানা চাপ রয়েছে। কিন্তু এটা নানা চেষ্টা করেও কমানো যাচ্ছে না। আর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে যে, অর্থঋণ আদালতে মামলার দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে অনেক গ্রাহক ইচ্ছাকৃত খেলাপি বনে যাচ্ছেন। এতে খেলাপি লাগামছাড়া হয়ে পড়েছে। এই খেলাপি কমাতে আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির বিকল্প দেখছেন না তারা। ব্যাংকিং খাতে অভিজ্ঞ একজন আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তৃতীয় পক্ষ হিসেবে খেলাপি ঋণের প্রায় সব মামলাতেই পার্টি থাকেন। সরাসরি তাদের দায় না থাকলেও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের দায় অনেক। খেলাপি ঋণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই গুরুত্ব সহকারে এগিয়ে আসতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত সারা দেশের অর্থঋণ আদালতে ২০ হাজার ৫৯৩টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ৩ হাজার ২৬৯ মামলা ঝুলছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ৪২টি মামলা। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব মামলার মধ্যে শুধু ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতেই বিচারাধীন রয়েছে ৮ হাজার ৫৭৮টি খেলাপি ঋণের মামলা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শুধু তাই নয়, গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত এটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা ৩০ মার্চ পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘পর্যাপ্ত সংখ্যক আদালত ও বিচারক সংকটের কারণে মামলাগুলো দীর্ঘদিন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকে। তিনি বলেন, খেলাপিদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের আইনি কাঠামো অন্যান্য দেশের মতো শক্তিশালী নয়। যা আছে সেই আইনি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী শক্তি সক্রিয় বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুনীরুজ্জামান বলেন, ঋণের এসব মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি পার্টি নয়। ঋণ গ্রহীতা ও ঋণদাতা ব্যাংক এখানে মূল পার্টি। কেউ আমাদের দ্বারস্থ হলে তাদের সর্বাত্মক সহায়তা করি। আমরা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে সব সময়ই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতাকে এগিয়ে আসতে হবে বলেও মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, যখন ব্যাংকগুলো বুঝতে পারে যে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আর খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে না, চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসেবে তারা মামলায় যায়। দেশে এই মামলার একমাত্র আদালত হচ্ছে অর্থ ঋণ আদালত। ক্রেডিট কার্ড খেলাপি থেকে শুরু করে ছোট বড় কোটি কোটি টাকার ঋণখেলাপি- সব মামলায় সব ব্যাংককে এই একটা আদালতেই যেতে হয়। যখন ঋণ আদায়ের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়, আমরা আশা ছেড়ে দেই, তখন সেটাকে রাইট-অফ করার জন্যও মামলা করতে হয়। সেই কারণে এখানে কেসের সংখ্যা অনেক বেশি।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ