মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাধা কেটেছে বে-টার্মিনাল নির্মাণে

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা আনন্দবাজার-কাট্টলী উপকূলে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত বে-টার্মিনালের জমি অধিগ্রহণের জন্য ছাড়পত্র হস্তান্তর করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ফলে ছাড়পত্র নিয়ে টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা দুই সংস্থার বিরোধের অবসান হয়েছে। গতকাল বন্দর কর্তৃপক্ষকে ছাড়পত্র হস্তান্তর করে সিডিএ। এ সময় সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রধান প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন, সচিব তাহেরা ফেরদৌস, চট্টগ্রাম বন্দরের এস্টেট অফিসার জিল্লুর রহমানসহ দুই কর্মকর্তা। গত ২১ নভেম্বর বে-টার্মিনাল নির্মাণে আর কোনো বাধা নেই বলে পূর্ব ঘোষণা দিয়েছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এমপি।

সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের স্বার্থে কাট্টলী সাগরপাড়ে আমাদের পরিকল্পিত ‘স্মার্ট সিটি’র পাশাপাশি ৯০৭ একর জায়গাজুড়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ বে-টার্মিনাল নির্মাণে আর  কোনো বাধা নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষের এস্টেট অফিসারের সঙ্গে বৈঠকের পর আমাদের ছাড়পত্রটি তাদের হস্তান্তর করা হয়েছে। এতদিন সিডিএর স্মার্ট সিটির জন্য নির্মিত আউটার রিংরোডটি বন্দর কর্তৃপক্ষকে ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়ার শর্ত নিয়েই টানাপড়েন চলে। বন্দর কর্তৃপক্ষকে বে-টার্মিনাল নির্মাণের সঙ্গে তাদের ব্যবহারের জন্য পৃথক ওভারপাস তৈরির শর্ত দেওয়া হয়েছিল। সেই শর্তে তারা রাজি হওয়ায় এখন আর কোনো বাধা রইল না।’

বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর উপকূল সংলগ্ন কাট্টলী এলাকায় জেগে ওঠা ভূমিতে চট্টগ্রাম বন্দর  বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব রাখে। ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসক থেকে ভূমি অধিগ্রহনের অনুমতির জন্য গেলে তারা বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে নিলেও ছাড়পত্রের জন্য সিডিএ নানা জটিলতা তৈরি করে। সেখানে স্মার্ট সিটি করবে তাই বে-টার্মিনাল নির্মাণ করা যাবে না বলে জানায় সিডিএ। এরপর আবার সিডিএ শর্ত দিল রিংরোড ব্যবহার না করে বে-টার্মিনালের জন্য নিজস্ব সড়ক তৈরি করতে হবে। নকশায় পরিবর্তন করে সেটি করা হলেও আবার তারা ছাড়পত্র না দিয়ে মতামতের জন্য সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। মন্ত্রণালয় নীতিগত সিদ্ধান্ত দিলে সিডিএ আর বাধা দেয়নি।

বন্দর বিশেষজ্ঞদের মতে— নতুন এই টার্মিনাল নির্মিত হলে বন্দরের অপারেশনাল কাজে নতুন গতি ও বিদেশকে ট্রানজিটসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান সহজ হবে। বে-টার্মিনাল বাস্তবায়ন হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র বদলে যাবে বলেও মনে করছেন বন্দর বিশেষজ্ঞরা। একদিকে ২৪ ঘণ্টা জাহাজের আনাগোনা ও পণ্য ওঠানামার কাজ চালানো সম্ভব হবে, অন্যদিকে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে জানান বন্দরের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা।

চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (প্রশাসন) মো. জাফর আলম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কাজ-কর্ম যে হারে বাড়ছে, তাতে বন্দরের সম্প্রসারণ জরুরি। ১০-১৫ বছর পরে বর্তমান বন্দর দিয়ে পণ্য ওঠানামানোয় হিমশিম খেতে হবে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুন টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ  নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই টার্মিনাল নির্মাণ হলে নগরীর চিত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে। অর্ধেকের চেয়ে বেশি ভারী যানবাহনের চাপ কমে আসবে মূল শহরে।

বন্দর ব্যবহারকারী ও সংশ্লিষ্টরা জানান—দেশের প্রধানতম বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয় ১২৭ বছর আগে। বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলী চ্যানেলে এটি টাইডাল পোর্ট হওয়ায় দিনে মাত্র ৪ ঘণ্টা জোয়ারের সময় নেভিগেশন সম্ভব হয়। রাতের জোয়ারে জাহাজ গমনাগমন সম্ভব হয় না। এতে দীর্ঘ সময় ধরে জাহাজগুলোকে অপেক্ষমাণ থাকতে হয়। তা ছাড়া বড় কোনো জাহাজ বন্দর জেটিতে প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু পরিকল্পিত ও প্রস্তাবিত নতুর বন্দরে এ ধরনের কোনো বাধা থাকবে না। রাতদিন ২৪ ঘণ্টায় জাহাজ ভেড়ানো ও পণ্য ওঠানামার কাজ চালানো সম্ভব হবে। হালিশহর-কাট্টলী চ্যানেলে সাগরের স্বাভাবিক নাব্য কর্ণফুলী বন্দর চ্যানেল থেকে বেশি বলে হাইড্রোগ্রাফার চিত্রে দেখা যায়। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হলে বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুব আলম।

বে-টার্মিনালের অন্যতম উদ্যোক্তা-পরিকল্পক বন্দর সদস্য জাফর আলম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ৯ দশমিক ৫০ মিটারের অধিক গভীরতার কোনো জাহাজ ভিড়তে পারে না। প্রস্তাবিত বে-টার্মিনালে ১৪ মিটার গভীর ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। বে-টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। বিকল্প এ বন্দর হলে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে পারবে পাঁচ হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে একদিনে সর্বোচ্চ হ্যান্ডেল করতে পারছে এক হাজার ৭০০ কনটেইনারবাহী জাহাজ। এ ছাড়া কর্ণফুলী চ্যানেলে সবসময় গড়ে ৪০০-৫০০ কার্গো জাহাজ, মাছ ধরার ট্রলার ও সমুদ্রগামী জাহাজ ছাড়াও শত শত সাম্পান ভিড় করে থাকে। পাশাপাশি দেশের সব তেল কোম্পানির স্থাপনা বন্দরের জেটি এলাকার মধ্যে। এতে ঝুঁকিতে পড়ছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরটি।

চট্টগ্রাম বন্দরকে দূষণমুক্ত রাখতে বে-টার্মিনালে কয়লা ও সিমেন্ট ক্লিংকার খালাস করার চিন্তা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাই আপাতত ডলফিন জেটি করে সেখানে এই দুটি পণ্য খালাস করতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আর এতে করে কর্ণফুলী ও বন্দরের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা যাবে। পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার আশা করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর