রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

আলাউদ্দিন টাওয়ারের লিফট ছিঁড়ে পড়েছিল গত বছরও

অগ্নিদগ্ধ আরও একজনের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর উত্তরায় ট্রপিক্যাল আলাউদ্দিন টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্সের লিফট ছিঁড়ে আগুনের ঘটনায় মাহমুদুল হাসান (৪০) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মাহমুদুল হাসানের শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে। এদিকে আগুনের ঘটনায় মার্কেট কমিটির হিসাব রক্ষক ওলিয়ার রহমান পলাশ বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেছেন। জানা গেছে, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় আলাউদ্দিন টাওয়ারে ছিঁড়ে পড়া লিফটির তার গত বছরও রোজার সময় ছিঁড়েছিল। কী কারণে লিফটের তার ছিঁড়েছিল এবং সেই ঘটনায় মার্কেট কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছিল তা এখনো অজানা। মার্কেটের কর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, তখন লিফটের তার ছেঁড়ার বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিলে হয়তো দ্বিতীয়বার এ দুর্ঘটনা ঘটত না। উল্লেখ্য, শুক্রবার সন্ধ্যায় আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলেই ছয়জনের মৃত্যু হয়। তারা হলেন— মাদারীপুরের খোয়াজ মিয়ার ছেলে জসিম উদ্দিন রফিক (৩৫), পাবনা আমিনপুরের খোরশেদ কাজীর ছেলে কাজী মিজানুর রহমান (৫৩), মুন্সীগঞ্জের বিল মোহাম্মদের মেয়ে লতা আক্তার (৩০), ফরিদপুর নগরকান্দার বাচ্চু মিয়ার ছেলে রেজাউল করিম রানা (৩২) ও শেরপুর শ্রীবর্দীর আনিছুর রহমানের স্ত্রী সালমা আক্তার (৪০)। তবে আরেকজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। তারা ঢামেক হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

মৃত মাহমুদুলের মেয়ে মেহেরাজ হোসেন মাইশা (১০) ও ছেলে মোমতাকিন হাসানও (৮ মাস) গুরুতর দগ্ধ হয়েছে। তারা ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছে। দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পার্থ শংকর পাল বলেন, মাইশার ৫৫ শতাংশ ও মোমতাকিনের ২৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। দুজনকে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বার্ন ইউনিটের প্রধান প্রফেসর ডা. আবুল কালামকে প্রধান করে ৮ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, মাহমুদুল হাসান আলাউদ্দিন মার্কেটের বেইজমেন্টে অবস্থিত আবাসন প্রতিষ্ঠান ট্রপিক্যাল হোমসের ডিজিএম ছিলেন। তার অফিসের কলিগদের পরিবার নিয়ে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। মাহমুদুল সন্তানদের নিয়ে আগেই অফিসে চলে আসেন। স্ত্রী মেহবুব হাসান উত্তরার সেক্টর-১৩, রোড-৩ এর ২১ নম্বর বাড়ি থেকে আসছিলেন। এর মধ্যেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। মাইশা মাইলস্টোন স্কুলের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী।

মাহমুদুলের সহকর্মী কামাল উদ্দিন জানান, আলাউদ্দিন টাওয়ারের বেইজমেন্ট ট্রপিক্যাল হোমসের একটি অফিস রয়েছে। সেখানে আয়োজিত ইফতারে অংশ নিতে দুই সন্তানসহ এসেছিলেন মাহমুদুল। তারা কার্যালয়ের ভিতরে ছিলেন। ইফতারের আগে ওই ভবনে বিদ্যুৎ ছিল না। জেনারেটরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় লিফট ছিঁড়ে নিচে পড়ে যায় এবং বিকট শব্দ হয়। বেইজমেন্ট এলাকায় আগুন ধরে গেলে দুই সন্তানসহ মাহমুদুল দগ্ধ হন।

ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি থাকা মামুন বলেছেন, তিনি রাজলক্ষ্মী মার্কেটের বিসমিল্লাহ মিষ্টির দোকানের কর্মচারী। ঘটনার আগে আলাউদ্দিন মার্কেটে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। তার দুই পা থেঁতলে গেছে। কিন্তু পায়ের ওপর কী পড়েছিল তা তিনি জানেন না।

গতকাল সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, আলাউদ্দিন টাওয়ারের ছয়তলা পর্যন্ত পোশাক, অলঙ্কার, ইলেকট্রনিকস, প্রসাধনীর দোকানপাট। ওপরের তলাগুলোতে বিভিন্ন অফিস। শপিং কমপ্লেক্সে প্রবেশমুখের দুই পাশে দুটি লিফট। এর মধ্যে বাঁ পাশের লিফটটি ছিঁড়ে নিচে পড়ে। ভবনের সামনের রাস্তাজুড়ে প্রচুর কাচের গুঁড়া এবং কিছু মানুষের জুতা-স্যান্ডেল, ভবনের ভিতরের দোকান থেকে ছিটকে আসা বিভিন্ন টুকরা জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। ভবনের ভিতরে পুলিশ কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি। শুধু ব্যবসায়ীদের তাদের দোকান বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। দোতলা ও তিনতলার এসির বাতাস ঢোকা ও বের হওয়ার পথ বিস্ফোরিত হয়ে ‘ফলস সিলিং’-এর বিভিন্ন অংশ ঝুলে থাকতে দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেইজমেন্ট এলাকা।

ওই মার্কেটের একাধিক দোকান ব্যবসায়ী জানান, ঘটনার দিনে ইফতারের আধা ঘণ্টা আগে তারা জোরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন। মার্কেটের প্রবেশপথে হাতের বাঁ পাশে ওই ঘটনা ঘটে। এর পরপরই তারা বেরিয়ে এসে দেখেন সেখানে আগুন ধরে গেছে। এটি ট্রান্সফরমার, নাকি বিদ্যুতের লাইন থেকে হয়েছে— তা বুঝতে পারেননি। তবে লিফটের ওখানেই বিস্ফোরণটি ঘটেছে। সকালে মার্কেট ব্যবসায়ীদেরকে নাম ধরে ডেকে ডেকে ভিতরে ঢুকতে দেয় পুলিশ। তবে মার্কেট বন্ধ রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান বলেন, গতকাল সকালে তাদের সব কার্যক্রম শেষ হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে বিশেষজ্ঞের মতামত প্রয়োজন। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মোজাম্মেল হককে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা পুরো মার্কেট ঘুরে দেখতে পারিনি। যতটা দেখেছি তাতে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে। বেইজমেন্টে তিনটি ফ্লোর রয়েছে। তা ফাঁকা থাকার কথা থাকলেও সেখানে মসজিদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস করা হয়েছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা রাজউক ও বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা পরিদর্শনের পর বলতে পারবেন।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি বিধান ত্রিপুরা বলেন, ছয়জনের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় মার্কেট কমিটির এক সদস্য বাদী হয়ে মামলা করেছেন। ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্টদের করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর