রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

হতাহতদের পরিবারে কেউ ভালো নেই

প্রতিদিন ডেস্ক

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার এক যুগ পূর্তি আজ। ওই ঘটনায় হতাহতদের পরিবার আজও ধুকছেন। কোনো পরিবার তাদের স্বজন হারিয়ে অসহায় দিন পার করছেন। কোনো পরিবারে আহতদের আহাজারি আজও চলছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর— চাঁদপুর : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার এক যুগপূর্তিতে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার পাঁচআনি গ্রামের আতিক উল্লাহর (৪৬) সন্তানরা জানতে চাইছে, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে আর কত দিনে? তারা দ্রুত এই হত্যাকাণ্ডসহ বাবার হত্যাকারীদের বিচার চান। আতিকের বড় ছেলে মিথুন সরকার দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। তার ভাষ্য, ‘আমরা ছোট ছিলাম, তখন খরচ কম ছিল। এখন আমরা চার ভাই-বোন বড় হচ্ছি। পড়ালেখার খরচও বাড়ছে। অনুদানের টাকায় মা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় বড় ছেলে হিসেবে আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করলে সরকারের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ১০ লাখ টাকার ঐচ্ছিক আয় দিয়ে চলছে আতিকের ৫ সদস্যের পরিবার। বড় মেয়ে তানিয়া আক্তার উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছে। এ ছাড়া মিন্টু সরকার ৮ম শ্রেণি ও ছোট ছেলে শাকিব ৭ম শ্রেণিতে পড়ছে। আতিকের স্ত্রী লাইলী বেগম বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও একই দাবি— স্বামী হত্যার বিচার চাই। এ বিচার আগেও চেয়ে আসছি। যতদিন শেষ না হবে চেয়ে যাব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেয়ে যাব। অপরদিকে একই ঘটনায় নিহত হন কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার চরকৃষ্ণপুর গ্রামের আবদুল কুদ্দুছ পাটওয়ারী (৩৫)। অবিবাহিত ছিলেন তাই পিছুটান বলে কিছু ছিল না কুদ্দুছের। তার বড় ভাই রুহুল আমিন পাটওয়ারী জানান, ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি আমার মা। দীর্ঘ নয় বছর বিচারের প্রতীক্ষায় থেকে তিনি পরপারে চলে গেছেন। এখন কুদ্দুছের বড় ভাই হিসেবে আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করছি।

মাদারীপুর : গ্রেনেড হামলায় মাদারীপুরের আহত তিনজনসহ নিহত চার পরিবারের সদস্যরা ভালো নেই। খোঁজ নিতে রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগ নেতা নিহত লিটন মুন্সির বাড়ি গেলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় লিটন মুন্সির মা আছিয়া বেগম, বাবা আইয়ুব আলী মুন্সি, বোন ইসমতআরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মা আছিয়া বেগম বলেন, ‘আমার বাবা (লিটন মুন্সি) বলেছিল, মা তোমার পেটের পাথর অপারেশন করে আনব। মাত্র ১০ দিন অপেক্ষা কর। ৯ দিনের মাথায় বাবা আমার লাশ হয়ে ফিরেছে।’ লিটনের বাবা আইয়ুব আলী মুন্সী বলেন, ‘আমার ছেলের তো কোনো দোষ ছিল না। আমার একমাত্র ছেলেকে কবরে শুইয়ে রেখে কীভাবে বেঁচে আছি বলতে পারেন?’

শুধু লিটন মুন্সিই নয়, ওইদিন মাদারীপুরের আরও তিনজন নিহত হন। তাদের একজন শ্রমিক লীগ নেতা নাসিরউদ্দিন। তার বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামপোল গ্রামে। নাছিরউদ্দিন থাকতেন ঢাকার হাজারীবাগে। সেই নাসিরউদ্দিনের বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের খবর কেউ রাখে না। গ্রেনেড হামলায় নিহত অপর যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহম্মেদ ওরফে কালা সেন্টুর বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর গ্রামে। নিহত সুফিয়া বেগমের বাড়ি রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী ইউনিয়নের মহিষমারী গ্রামে।

অপরদিকে কালকিনি পৌরসভার বিভাগদী গ্রামের মোহাম্মাদ আলী হাওলাদারের ছেলে হালান হাওলাদারের একটি পা গ্রেনেড হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাকে। এ ছাড়া কালকিনির ঝাউতলা গ্রামের ওয়াহেদ সরদারের ছেলে সাইদুল হক সরদার শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাকর জীবনযাপন করছেন। বর্তমানে চোখে ঝাপসা দেখছেন। এ ছাড়াও গ্রেনেড হামলায় কালকিনির কৃষ্ণনগর গ্রামের কবির হোসেনের ডান হাত বাঁকা হয়ে গেছে। তিনি ঢাকার এক বস্তিতে থাকেন। তিনি দিনমজুরের কাজ করেন।

কুষ্টিয়া : শাহাদাতবরণের একযুগ পরও প্রিয় সন্তান মাহবুবের স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন বৃদ্ধ বাবা হারুন-অর রশীদ, আর মা হাসিনা বেগম। তারা ছেলে হত্যাকারীদের বিচারের আসায় দিন গোনেন। ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত ২৩ জনের একজন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ফুলবাড়ী গ্রামের মাহাবুব রশীদ। তার অকাল মৃত্যু বদলে দিয়েছে গোটা পরিবারের জীবন চিত্র। টেনেটুনে জীবন চলে গেলেও অসহায় পরিবারটির খোঁজ রাখে না কেউ।

বৃদ্ধ বাবা হারুন-অর রশীদ বলেন, ছেলে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছে, এতে আমরা গর্বিত। তবে আফসোস আজও বোমা হামলাকারীদের শাস্তি না হওয়ায়। মাহবুবের বোন আবিদা সুলতানা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় মাহবুবের স্ত্রী ও দুই ছেলে ঢাকায় থাকে। মাহবুবের বড় ছেলে প্রকৌশল ও ছোট ছেলে চিকিৎসা বিদ্যায় পড়ালেখা করছে। মাহবুবের স্ত্রী-সন্তানের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সময় গ্রামে তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের কিছু সাহায্য-সহযোগিতা করলেও আজ আর কেউ তাদের খোঁজ রাখেন না।

এদিকে ফুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট্ট কবরস্থানে মাহাবুব রশীদের শেষ ঠিকানা হলেও তার কবরটিও পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। এতে হতাশ পরিবারের লোকজন ও স্থানীয়রা। এলাকাবাসীর দাবি, অবিলম্বে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি নিজ গ্রামের একটি রাস্তার নাম মাহবুবের নামে রাখা হোক।

সর্বশেষ খবর